বিতর্কিত ধারা
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে ক্ষোভ বিশিষ্টজনদের
মানবাধিকারের বিষয় অগ্রাহ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সংশ্লিষ্ট কনভেনশনের সঙ্গে কিছু ধারা সাংঘর্ষিক
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিতর্কিত ধারা বহাল থাকায় নতুন সাইবার সুরক্ষা আইনের খসড়া অধ্যাদেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তাদের ভাষ্য-‘সাইবার সিকিউরিটি আইন-২০১৮’ বাতিল করে ‘ডিজিটাল সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৪’ জারির উদ্যোগ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশাল বিশ্বাসঘাতকতা। এই অধ্যাদেশে জনগণের মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়গুলো সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এ অধ্যাদেশ মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা লঙ্ঘনের নতুন হাতিয়ার।
শনিবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘ভয়েস ফর রিফর্ম’-এর গোলটেবিল আলোচনায় দেশের বিশিষ্টজনরা এ মন্তব্য করেন। মানবাধিকারকর্মী আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তৃতা করেন জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক মানবাধিকারকর্মী আইরিন খান, মানবাধিকারবিষয়ক আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের দিদারুল আলম ভূঁইয়া, রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার ফুয়াদ, ববি হাজ্জাজ, ই-আরকির প্রধান সিমু নাসের, টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের সাবহানাজ রশীদ দিয়া, ভয়েস ফর রিফর্মের আহ্বায়ক ফাহিম মাশরুর প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আইরিন খান বলেন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মানবাধিকারসংশ্লিষ্ট কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। এ আইনের বেশকিছু ধারা সেগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে এই অধ্যাদেশের খসড়াটির মিল দেখে মনে হয়েছে, আমি সাইবার নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সরকারকে যে চিঠি লিখেছিলাম, সেই চিঠির একটু অদলবদল করে এই সরকারকে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে সবার ওপরে থাকে মানবাধিকার। কোনো সরকারই মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা করছে না, তারা নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, অধ্যাদেশের ভাষা অস্পষ্ট। এতে ঝুঁকি থাকে। কারণ এতে ক্ষমতাসীনরা আইনের অপব্যবহারের সুযোগ পায়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য ২৫ ও ২৬ দুটি ধারাতেই সমস্যা রয়েছে। অপতথ্য ও ভুল তথ্যের বিষয়গুলো অধ্যাদেশে আসেনি। মানহানি কেন ফৌজদারি আইনে থাকবে সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকিতে পড়বে।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, নারী-শিশুসহ যাদের সুরক্ষার জন্য এ আইনে নতুন কিছু ধারা যুক্ত করা হয়েছে, তাদের সঙ্গেই কোনো কথা বলা হয়নি নতুন এই অধ্যাদেশটি তৈরি করার সময়।
দিদারুল আলম ভূঁইয়া অভিযোগ করে বলেন, আগের সাইবার নিরাপত্তা আইন দিয়ে যাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। যদিও অনেক উপদেষ্টা ও বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সেগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে। আলোচনায় ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেন, আমলারা সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করছে বলেই এ রকম বাজে ও গণবিরোধী একটি অধ্যাদেশ সামনে আনা হয়েছে।
ফাহিম মাশরুর বলেন, এ অধ্যাদেশের সবচেয়ে বড় খারাপ দিকটা হচ্ছে পুলিশের হাতে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারি ক্ষমতা দেওয়া। এর মাধ্যমে পুলিশকে জনগণকে হয়রানি ও চাঁদাবাজির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুলিশ ইচ্ছা করলেই যে কারও মোবাইল তল্লাশি করতে পারবে, যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার লঙ্ঘন।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের কাঠামোর ওপরই সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশটি হয়েছে। এখানে ভাষাগত কিছু পরিবর্তন আছে। তবে আগের মতোই সাধারণ নাগরিক, বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণি, বিশেষ করে সাংবাদিকরা এক ধরনের উৎকণ্ঠায় রয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রণের চিন্তা থেকে অধ্যাদেশটি হয়েছে।
শহিদুল আলম বলেন, কয়েক হাজার জীবনের বিনিময়ে যে পরিবর্তন এসেছে ও তার ধারাবাহিকতায় যে নতুন সরকার এসেছে, তাদের কাছ থেকে এ রকম একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অধ্যাদেশ কোনোভাবেই আশা করা যায় না। খসড়া অধ্যাদেশটি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।