দফায় দফায় চিঠি দিয়েও সাড়া মিলছে না
বিদেশি ৯ বন্দির মরদেহ বিপাকে কারা কর্তৃপক্ষ
ফাইল ছবি
মোহাম্মদ আলী, বাবার নাম সলামত, ঠিকানা করাচি পাকিস্তান। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় মারা যান ২০২১ সালের ১৮ জুন। তার লাশ সংরক্ষণ করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মরচ্যুয়ারিতে। এখনো সেখানেই আছে লাশ। সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষকে লাশ বুঝে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আটবার পত্র পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।
ইমতাজ ওরফে ইনতাজ, বাবার নাম ফারুক আলী, ঠিকানা উত্তর প্রদেশের গন্ডা জেলার কাটরা থানার পিপিরি মনঝা, ভারত। চিকিৎসার জন্য নীলফামারী জেলা কারাগার থেকে তাকে আনা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে বন্দি অবস্থায় মারা যান ২০২১ সালের ১৪ জুলাই। তার লাশ সংরক্ষণ করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মরচ্যুয়ারিতে। এখনো সেখানেই আছে ইনতাজের লাশ। সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষকে লাশ বুঝে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আটবার পত্র পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।
শুধু মোহাম্মদ আলী বা ইনতাজই নয়, বছরের পর বছর ধরে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের মরচ্যুয়ারিতে ফ্রিজিং অবস্থায় রাখা আছে নয় বিদেশি বন্দির মরদেহ। এদের মধ্যে একজন পাকিস্তানি ও আটজন ভারতীয় নাগরিক। মরদেহগুলো নিয়ে বিপাকে পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। মরচ্যুয়ারিতে অপর্যাপ্ত স্থান, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও শীতাতপ যন্ত্রের ত্রুটির কারণে দেহগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এগুলো মরচ্যুয়ারিতে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে সরকারের অর্থিক খরচ হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। লাশপ্রতি দিনে মরচ্যুয়ারি বিল দিতে হচ্ছে দেড় হাজার টাকা করে। সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে সরকারের গচ্চা গেছে প্রায় এক কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোহাম্মদ আলী এবং ইনতাজের লাশ সংরক্ষণে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৯ লাখ টাকা করে। আরও যেসব বিদেশি নাগরিকের মরদেহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সংরক্ষিত আছে তারা হলেন-তারেক বাইন, সতেন্দ্র কুমার, খোকন দাস, বাবুল সিং, অশোক কুমার, কুনালিকা এবং সুরাজ সিং। এদের মধ্যে তারেক বাইনের বাবার নাম মরন বাইন মিয়া। তার বাড়ি ভারতের পশ্চিম বিহার জেলার সোনাগ্রাম এলাকায়। মৃত্যুর আগে তিনি গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে বন্দি ছিলেন। সংরক্ষণের জন্য তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মরচ্যুয়ারিতে নেওয়া হয়। তিনি ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর মারা যান। মৃতদেহ হস্তান্তরের জন্য ইতঃপূর্বে তিন দফা পত্র পাঠানো হয়েছে। তারেকের দেহ সংরক্ষণে এ পর্যন্ত ১২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
মৃত সতেন্দ্র কুমারের বাবা চন্দ্র পাল। তার বাড়ি ভারতের দিল্লির সাধুরা সুলতানপুর জেলার চেয়াপুর থানা এলাকায়। তিনি শরীয়তপুর জেলা কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি মারা যান। তার মরদেহ শরীয়তপুর ১০০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালে সংরক্ষিত আছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যে চারবার পত্র দেওয়া হয়েছে। তার দেহ সংরক্ষণে এ পর্যন্ত ১১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। মৃত খোকন দাসের বাবার নাম অচিন দাস। খোকনের বাড়ি ভারতের কলকাতার নন্দীগ্রামে। ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। চিকিৎসার জন্য তাকে শরীয়তপুর জেলা করাগার থেকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। তার মরদেহ হস্তান্তরের বিষয়ে কারা অধিদপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যেই চার দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। খোকনের মৃতদেহ সংরক্ষণে ব্যয় হয়েছে প্রায় নয় লাখ টাকা।
আরও জানা গেছে, বাবুল সিং শরীয়তপুর জেলা কারগারে বন্দি অবস্থায় ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল মারা যান। তার দেহ শরীয়তপুর ১০০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালে সংরক্ষিত আছে। তার বিষয়েও কারা অধিদপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চার দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। এদিকে তার দেহ সংরক্ষণে এ পর্যন্ত প্রায় নয় লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে কারাসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র আরও জানায়, মৃত অশোক কুমারের বাবার নাম মহেষ আগরওয়াল। বাড়ি দিল্লির বিলাসপুর জেলার খেরট গ্রামে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি ২০২৩ সালের ২ আগস্ট মারা যান। চিকিৎসার জন্য তাকে নেত্রকোনা জেলা কারাগার থেকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মরচ্যুয়ারিতে আছে। অশোকের মৃতদেহ হস্তান্তরের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ইতোমধ্যে দুদফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। তার মরদেহ সংরক্ষণে ইতোমধ্যেই ব্যয় হয়েছে প্রায় সাত লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মৃত কুনালিকার বাড়ি ভারতের ঝাড়খন্ড জেলার হিংগুলি থানার জামাটি গ্রামে। তার বাবার নাম শাম্মাদি। তিনি লালমনিরহাট জেলা কারাগারে বন্দি ছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকায় আনা হয়। পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অধীন চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের মরচ্যুয়ারিতে সংরক্ষণ করা আছে। এই মৃতদেহ সংরক্ষণে ইতোমধ্যে প্রায় সাত লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, মৃত সুরাজ সিংয়ের বাবার নাম সুদ্ধ সিং। খুলনা জেলা কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় ৭ জুলাই তিনি মারা যান। তার মরদেহ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মরচ্যুয়ারিতে রয়েছে।
কারা সূত্র জানায়, সারা দেশের ৬৮টি কারাগারে এই মুহূর্তে ৪৬৭ জন বিদেশি বন্দি আছেন। কোনো বিদেশি বন্দি মারা গেলে তার লাশ হস্তান্তরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের হাইকমিশন বা দূতাবাসকে চিঠি দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী মরদেহ যাচাই করে হাইকমিশন বা দূতাবাস পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু ভারত এবং মিয়ানমার সাধারণত মরদেহগুলো যাচাই করে না। গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানও একই ধরনের নীতি অবলম্বন করছে। এ কারণে ২০২১ সালের ১৮ জুন থেকে চলতি বছরের ৭ জুলাই পর্যন্ত সময়ে মারা যাওয়া আট ভারতীয় ও এক পাকিস্তানি মৃত বন্দির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে এআইজি (প্রিজন্স) জান্নাতুল ফরহাদ যুগান্তরকে বলেন, ভারত-বাংলাদেশ বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যেই জাতীয়তা যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বারবার পত্র দেওয়ার পরও দীর্ঘদিনেও দুটি দেশ নয়জন বন্দির জাতীয়তা যাচাই না করায় বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশ দুটি তাদের মৃতদেহগুলো গ্রহণ না করলে দেশের আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম বা অন্য কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে দাফন-কাফন বা সৎকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে।