Logo
Logo
×

শেষ পাতা

শীতে বাড়ছে অগ্নিদুর্ঘটনা

বার্ন ইনস্টিটিউটে পোড়া রোগীর ভিড়

শীতে পোড়া রোগীর ৬০ শতাংশই নারী ও শিশু * ৫০ ভাগই গোল্ডেন আওয়ারে চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বার্ন ইনস্টিটিউটে পোড়া রোগীর ভিড়

ছবি: সংগৃহীত

১৪ ডিসেম্বর দুপুর প্রায় দেড়টা। গরম পানিতে ঝলসানো শরীর নিয়ে রাজধানীর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি’ হাসপাতালের নয়তলার ব্লু ইউনিটের ১৭ নম্বর বিছানায় কাতরাচ্ছিল ১১ মাস বয়সি শিশু রাব্বি। সন্তানের শয্যায় বসে মা মৌসুমী আক্তার নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পাশেই ওয়ার্ডের মেঝেতে হাঁটু মুড়ে নিশ্চুপ বসে ছিলেন বাবা রফিকুল ইসলাম।

জানতে চাইলে মৌসুমী আক্তার বলেন, সামান্য ঠান্ডাতেই বাচ্চার সর্দি-কাশির সমস্যা হয়। শীত শুরুর পর গরম পানি দিয়ে গোসল করাতাম। প্রতিদিনের মতো ৩০ নভেম্বর দুপুরে ঘরের মেঝেতে রাখা হিটারে গোসলের জন্য পানি গরম দিয়ে ওয়াশরুমে বালতি আনতে যাই। ওই সময় অবুঝ ছেলে হিটার ধরতে গেলে গরম পানিতে তার দুই হাত, দুই পা ও বুকসহ শরীরের ৪০ শতাংশ ঝলসে যায়। দ্রুত সাড়ে চার হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে চাঁদপুরের মতলব মান্দারতলীর বাড়ি থেকে এখানে নিয়ে আসি। বার্ন ইনস্টিটিউটে আনার পর ৮ দিন আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর এই ওয়ার্ডে দেয়।

ঊরু থেকে গলা পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়ানো শরীর নিয়ে একই ওয়ার্ডের ৯ নম্বর শয্যায় দেখা যায় ১০ বছরের শিশু রিমাকে। দগ্ধ শরীরে যন্ত্রণাকাতর মেয়েটির ডান হাতে পরানো ক্যানুলা দিয়ে স্যালাইন চলছিল। তরল খাবার খাওয়াতে নাকে পরানো নলটি ঝুলছিল। একভাবে থাকতে না পেরে শুইয়ে দেওয়ার জন্য কান্নারত অবস্থায় পাশে থাকা মা ও খালাকে তাগাদা দিচ্ছিল ছোট্ট রিমা। পরে রীতিমতো কসরত করে তাকে উপুড় করে শুইয়ে দেওয়া হয়।

রিমার খালা তাসলিমা বেগম যুগান্তরকে বলেন, তরকারি গরম করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত চুলার আগুন রিমার জামায় ধরে যায়। আগুনে ডান পাঁজর, নিতম্বের একাংশ ও দুই পায়ের হাঁটুসহ শরীরের ৩৫ শতাংশ পুড়ে যায়। দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা ৫ দিন ভর্তি রাখার পর এখানে রেফার্ড করেছেন। সেখানে চিকিৎসা বাবদ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। এখানে আসার পর অস্ত্রোপচার করে ৭ দিন আইসিইউতে রাখা হয়। পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এই ওয়ার্ডে দিয়েছে। তাসলিমা আরও বলেন, ভর্তির পর ৭০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে। এমনও হয়েছে দিনে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার ওষুধ লেগেছে।

শুধু এই দুই পরিবার নয়, তাদের মতো আরও অনেক অভিভাবক বার্ন ইনস্টিটিউটে এসেছেন, যাদের শিশুর শরীর গরম পানিতে পুড়ে গেছে। দগ্ধদের চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতালটিতে সরেজমিন ঘুরে শিশুদের পাশাপাশি পোড়া শরীরে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখা যায় তরুণ থেকে শুরু করে বয়স্কদেরও। তাদের কেউ এসেছেন গোসলের গরম পানিতে দগ্ধ হয়ে। কেউ শীতের মধ্যে রান্নার চুলায় আগুন পোহাতে গিয়ে কিংবা কাপড় শুকাতে গিয়ে পুড়েছেন। অনেকে গরম পানি, গরম চা, দুধ, ডাল, তরকারি, ভাতের মাড় বা এ জাতীয় জিনিসে পুড়ে দগ্ধ হয়েছেন। অনেকে গ্যাস সিলিন্ডার, বিদ্যুৎস্পৃষ্টসহ অন্য আগুনে দগ্ধ হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পোড়া। ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া রোগীও ভর্তি আছেন। আগুনে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোড়ার পর থেকে ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছেন না। শরীরের বিভিন্ন অংশে পোড়ার কারণে যন্ত্রণায় ছটফট করার এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা গেছে।

ন্যাশনাল বার্ন ইনস্টিটিউট সংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে জানান অক্টোবরে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫ হাজার ৬৩৮ জন। এর মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ৫৮৬ জন। এ সময় বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৩৭৮ এবং জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ১২৬০ জন। নভেম্বরে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯৬৩ জনে। এরমধ্যে ভর্তি হয়েছেন ৬৬২ জন। আর বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৭৪৭ এবং জরুরি বিভাগে নিয়েছেন ১২১৬ জন। ডিসেম্বরের প্রথম ২২ দিনে আগুনে পুড়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬৪৯৫ জন রোগী। এর মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ৪৪২ জন। আর বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৫৭৪ জন এবং জরুরি বিভাগে নিয়েছেন ৯২১ জন।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, শীতে দুর্ঘটনা বাড়ায় গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ২১ ও ২২ ডিসেম্বর দুদিনে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮১৬ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৪০০র বেশি বিভিন্নভাবে পোড়া রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইনস্টিটিউটের ২০ শয্যার আইসিইউ, ২৭ শয্যার মেল এইচডিইউ এবং ৩০ শয্যার ফিমেল এইচডিইউর প্রায় সব রোগীতে পূর্ণ। যাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু এবং নারী।

৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ বছরের জুনে যত সংখ্যক পোড়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছিলেন তার প্রায় কাছাকাছি সংখ্যক রোগী অক্টোবরে শুধু গরম পানিতে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। জুনের তুলনায় অক্টোবর ও নভেম্বরে শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ।

ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাওন বিন রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশে প্রথমত, ইলেকট্রিক বার্ন অর্থাৎ বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হন বেশি। দ্বিতীয়ত, স্ক্যাল্ব বার্ন তথা গরম পানি, গরম তেল বা গরম কোনো তরল পদার্থে পুড়ে। যেটি শীতকালে বেশি ঘটে। তৃতীয়ত, ফ্লেম বার্ন তথা সরাসরি আগুনের সংস্পর্শে পুড়ে থাকে যেমন; মোমবাতি, কেরোসিন বাতি, চুলা বা অন্যভাবে শাড়ি, ওড়না, জামা-পায়জামা বা পরিধেয় বস্ত্রে আগুন লাগা। চতুর্থত, কেমিক্যাল বার্ন তথা দাহ্য পদার্থ জাতীয় রাসায়নিকে পুড়ে থাকেন।

হাসপাতালে বহির্বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শফিকুল আলম সুমন যুগান্তরকে বলেন, কারও আগুনে ইনহেলশেন ইনজুরি অর্থাৎ শ্বাসনালি পুড়ে গেলে তখন প্রাণহানির শঙ্কা বেড়ে যায়। এছাড়া শরীরে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পুড়লে মেজর বার্ন ধরা হয়। এসব রোগীর চিকিৎসা চ্যালেঞ্জ হয়।

তিনি বলেন, শীতকালে গরম পানিতে দগ্ধ মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এই সময়ে রান্না শেষে কখনো গরম হাঁড়ি-পাতিল ফ্লোরে বা মেঝেতে রাখা যাবে না। এসব সব সময় উঁচু জায়গায় বা শিশুদের নাগালের বাইরে রাখা উচিত। আর গোসলের সময় গরম পানির পাতিল বাথরুমে না নিয়ে বরং বালতি রান্নাঘরে এনে গরম পানি নেওয়া উচিত। এতে ঝুঁকি অনেক কম থাকে। এ ছাড়া গ্রামে আগুন পোহাতে গিয়ে কিংবা মাটির চুলায় রান্নার সময় অনেকেই দগ্ধ হন। তাই শীতে আগুন পোহানো থেকে দূরত্বে থাকতে হবে।

তিনি বলেন, প্রথমে পোড়া স্থান ঠান্ডা পানিতে ২০ থেকে ৩০ মিনিট ধুয়ে নিতে হবে। তবে বরফ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কেননা পোড়া বা দগ্ধ রোগীর চিকিৎসার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এজন্য অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া জরুরি।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে জানান-পোড়া কোনো রোগ নয়, এটি দুর্ঘটনা। দিন যত যাচ্ছে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। দেশে প্রতিবছর বিভিন্নভাবে প্রায় ৮ লাখ মানুষ অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। অধিকাংশ পোড়া রোগীর শারীরিক সমস্যা জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও ভিন্ন। দগ্ধের ধরন ও মাত্রাভেদে টানা দুই বছরও চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হয়। টিমওয়ার্কভিত্তিক চিকিৎসা লাগে। তবে এখনো উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে পোড়া রোগীদের সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। এতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা দগ্ধ ব্যক্তিদের ৫০ ভাগই গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে (দুর্ঘটনার প্রথম ২৪ ঘণ্টা) হাসপাতালে ভর্তি হতে ব্যর্থ হন। এতে শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতি বেড়ে যায়। মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাওয়াসহ অনেককে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বও বরণ করতে হয়।

জানা গেছে পোড়া রোগীদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে ঢাকার বাইরে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এগুলো পরিচালিত হবে সিলেট, রংপুর, বরিশাল, রাজশাহী ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে। তবে ৫ আগস্টের পর প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হওয়ায় কাজ থেমে আছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম