খুলনা নৌযান মেরামত কারখানা
১৫ প্রভাবশালীর দখলে সাড়ে তিন একর জমি
রূপসা নদী ভরাট করে চলছে ব্যবসা * থমকে আছে কারখানা ও ইনস্টিটিউশন নির্মাণ
আহমদ মুসা রঞ্জু, খুলনা
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
খুলনায় ১৫ প্রভাবশালীর দখলে রয়েছে নৌযান মেরামত কারখানার প্রায় সাড়ে তিন একর জমি। দীর্ঘদিন ধরেই জবরদখলের মাধ্যমে ব্যবসা করছেন এসব প্রভাবশালীরা। জমির পরিধি বাড়াতে প্রতিনিয়ত ভরাট করছেন রূপসা নদী। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে নদীর আকার ছোট হচ্ছে। অবিলম্বে এই জমি দখলমুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, খুলনার ১নং কাস্টম ঘাট এলাকা থেকে ২নং স্লুইস গেট পর্যন্ত রাস্তা ঘেঁষে জেলা প্রশাসনের জমি রয়েছে তিন দশমিক তেত্রিশ (৩.৩৩) একর। খুলনায় নৌযান মেরামত কারখানা স্থাপন করতে এই জমি ২০১৭ সালে যানবাহন অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দেয় খুলনা জেলা প্রশাসন। ওই জমির বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৫৭ কোটি ৩২ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। তবে খুলনা জেলা প্রশাসন জমিটি মাত্র এক লাখ এক হাজার টাকা প্রতীকী মূল্যে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়। এছাড়া ওই জমির পাশাপাশি প্রায় এক কিলোমিটার নদীর অংশজুড়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জমির রয়েছে ১৮০ ফুট করে। এই পুরো জায়গা বেদখল হয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে। এখান থেকে সরকারের কোনো রাজস্ব আয় হয় না। গত ১৫ বছর ধরেই ইজারা দেওয়া বন্ধ রয়েছে। জেলা প্রশাসনের খাসজমির পাশাপাশি প্রতিনিয়ত নদীতে বালু ফেলে ভরাট করছেন ব্যবসায়ীরা। জায়গাজুড়ে এখানে গড়ে উঠেছে কাঠ গোলা, ইট, বালু, কয়লা ও পাথরের ব্যবসা। এর পাশেই আবাসিক এলাকা। আবাসিকের একটি বড় অংশ ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দারাও এই ব্যবসা স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। তবে দখলদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় তারা মুখ খুলতে সাহস পান না। দখলকারীর তালিকায় রয়েছেন-খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক, আওয়ামী লীগ নেতা সাত্তার খলিফা, বিএনপি নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর মাহবুব কায়সার, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাইয়ুম, বাহাউদ্দিন হোসেন, আকরাম হোসেন, আইয়ুব হোসেন, শহিদুল ডাক্তার, বেল্লাল তালুকদার, কমল সিদ্দিকী, নান্টু, মনির হোসেন, ইউসুফ আলী, ছোট কাজল ও বড় কাজল।
ব্যবসায়ী বেল্লাল তালুকদার বলেন, আমরা এখানে ব্যবসা পরিচালনা করছি ছোট কাল থেকে। মাঝে মাঝে সরকারি লোকজন এসে মাপ নিয়ে যায়। পরে আর কোনো খোঁজ থাকে না। আমরা চাই রেভিনিউ দিয়ে ব্যবসা করতে। তবে সরকার তো রেভিনিউ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাহলে তো অবৈধভাবে ব্যবসা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
বিএনপি নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর মাহবুব কায়সার বলেন, এখানে নৌযান মেরামত কারখানা হবে শুনেছি। আওয়ামী লীগ আমলে লুটপাটের প্রকল্প নেওয়া হতো, এটাও সে রকম একটি প্রকল্প ছিল। এই প্রকল্প এখানে হতে দেওয়া হবে না।
খুলনা সিটি করপোরেশনের ২২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা সাত্তার খলিফা বলেন, এখানে আমরা পুরোনো ব্যবসায়ী। সরকার জায়গা নেবে শুনেছি তবে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। সরকার এখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এলে তখন পরিস্থিতির আলোকে কাজ করব। ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, অনেক বছরে এই এলাকা ব্যবসায়িক পয়েন্ট হিসাবে গড়ে উঠেছে। বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সরকার আমাদের বন্দোবস্ত দেওয়া বাতিল করেছে। আমরা সেভাবেই ব্যবসা করে আসছি। সরকার কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগে আমাদের বিকল্প সুযোগ রাখবে বলে প্রত্যাশা করি। এদিকে সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক আত্মগোপনে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, খুলনায় পণ্য আনা-নেওয়া হয় নদীকে কেন্দ্র করে। এ এলাকায় কেন্দ্রীয় নৌযান মেরামত কারখানা না থাকায় সরকারি-বেসরকারি নৌযানগুলো মেরামত ও সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সে লক্ষ্যে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর খুলনায় কেন্দ্রীয় নৌযান মেরামত কারখানা ও একটি আধুনিক নৌযান প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ২০১৭ সালে। কারখানা তৈরির উপযোগী জায়গা খুঁজতে থাকে সরকারি এ দপ্তরটি। পরে খুলনা জেলা প্রশাসন রূপসা নদীর পাড়ে খাস জায়গাটি বুঝিয়ে দেয় যানবাহন অধিদপ্তরকে। তবে জমি চূড়ান্ত করার পর কাজে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। থমকে রয়েছে কারখানা ও ইনস্টিটিউশন নির্মাণের বাকি কাজ।
এ বিষয়ে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. সাদ্দাম হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ২০১৭ সালে জমি বুঝে পাওয়া গেলেও করোনার কারণে নতুন প্রকল্প নিয়ে সামনে এগোনো যায়নি। সম্প্রতি খুলনার কারখানার বিষয়ে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অধিদপ্তরের কমিশনারসহ একটি টিম খুলনা সফল করবেন খুব শিগগিরই। এরপর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।