
রাজধানীর রাত ও ভোর এখন পথচারীদের জন্য আতঙ্কের। ছিনতাইকারী ও ডাকাতদের দৌরাত্ম্য ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ৪ মাসে শুধু ছিনতাই-দস্যুতার মামলা হয়েছে ৬৫টি। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা আরও বেশি। অনেকেই মামলার ঝামেলা এড়াতে জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এমন পরিস্থিতিতেও নিষ্ক্রিয় রয়েছে ডিএমপির পুলিশ ফাঁড়িগুলো। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ পুলিশের শীর্ষ কর্তারাও। এক্ষেত্রে ফাঁড়ি ইনচার্জদের কড়া বার্তাও দেওয়া হয়েছে।
রোববার সকালে ডিএমপি সদর দপ্তরের কনফারেন্স রুমে সব পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জদের নিয়ে বিশেষ বৈঠক করেছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। বৈঠকে ডিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে ফাঁড়ির নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ডিএমপি কমিশনার। ছিনতাইসহ অপরাধ ঠেকাতে ফাঁড়ি ইনচার্জদের প্রতি কড়া নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেছেন, পরে যদি ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা সংঘটিত হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকার ফাঁড়ি ইনচার্জকে সাসপেন্ড করা হবে। কোনো অন্যায়কে বরদাশত করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন কমিশনার। তবে বৈঠকে উপস্থিত ফাঁড়ি ইনচার্জদের মধ্যে কয়েকজন বলেছেন তাদের নানা সীমাবদ্ধতার কথা। বেশিরভাগ ফাঁড়িতে জনবল সংকট ও পরিবহণ ব্যবস্থা নেই। হেঁটে তারা দায়িত্ব পালন করছেন।
বৈঠকে উপস্থিত ডিএমপির শীর্ষ এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘ফাঁড়ি ইনচার্জদের নিয়ে করা বিশেষ ওই বৈঠকে ফাঁড়ির কার্যক্রম নিয়ে হতাশ হয়েছেন কমিশনার স্যার। ছিনতাই, ডাকাতি ও মাদক নিয়ন্ত্রণে ফাঁড়িগুলো কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি। ফলে কমিশনার স্যার কঠোর বার্তা দিয়েছেন। যে কোনো মূল্যে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ঠেকাতে নির্দেশ দিয়েছেন।’
জানা গেছে, রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ৫০টি থানার অধীনে রয়েছে ৫২টি পুলিশ ফাঁড়ি। এসব ফাঁড়িতে উপপরিদর্শকরা (এসআই) ইনচার্জ হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ফাঁড়ির সদস্যরা তাদের নিজ এলাকায় সার্বক্ষণিক তৎপর থাকলে অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ ফাঁড়ি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ফাঁড়ি ইনচার্জদের অনেকের কাছে কাজের সফলতার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু বেশরভাগ ইনচার্জ তেমন সফলতার কিছু বলতে পারেননি। ফাঁড়িগুলোর ব্যর্থতার বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে একপর্যায়ে সভা ত্যাগ করেন ডিএমপি কমিশনার। বৈঠকে অনেক ইনচার্জ জনবল সংকট ও ফাঁড়িগুলোর কোনো পরিবহণ ব্যবস্থা না থাকার বিষয়টিও তুলে ধরেন।
ডিএমপির চকবাজার থানার অধীনে রয়েছে চকবাজার পুলিশ ফাঁড়ি। এখানে জনবল রয়েছে ২৫ জন। কিন্তু তাদের দায়িত্ব পালনে কোনো যানবাহন নেই। হেঁটে দায়িত্ব পালন করেন তারা। ফাঁড়ির ইনচার্জ রয়েছেন এসআই গোলাম মোস্তফা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর পুলিশ পুনর্গঠনের অংশ হিসাবে তিনি এই ফাঁড়ির দায়িত্বে এসেছেন। তবে এই সময়ের মধ্যে কতজন ছিনতাইকারী গ্রেফতার করতে পেরেছেন সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। রোববার সকালে ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকের বিষয়ে এসআই গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, ‘ছিনতাই ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
লালবাগ থানার আজিমপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই নজরুল ইসলাম। গত এক মাস তিনি ফাঁড়ির দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর সন্দেহজনক একজন ছিনতাইকারীকে ধরেছি। ধরার পর তার পিসিপিআর (পূর্ববর্তী দণ্ড ও রেকর্ডগুলো) অনুযায়ী নিয়মিত ডাকাতি মামলা থাকায় সেই মামলাই চালান করা হয়েছে। নতুন করে কোনো মামলা দেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, কমিশনার স্যারের নির্দেশনা শোনার জন্য আমরা বৈঠকে গিয়েছিলাম। ছিনতাইকারী ধরার জন্য হার্ডলি নির্দেশনা দিয়েছেন স্যার। নির্দেশনাগুলো এখন আমরা বাস্তবায়ন করব।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভেঙে পড়ে রাজধানীসহ সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপরই পুলিশকে পুনর্গঠন শুরু করে সরকার। এসময় রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় সব থেকে বেশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। একপর্যায়ে যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করে। এরপরও মাঝে মধ্যেই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে এ থানা এলাকায়। মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় রয়েছে পুলিশের দুটি ফাঁড়ি (মোহাম্মদপুর পুলিশ ফাঁড়ি ও রায়ের বাজার পুলিশ ফাঁড়ি)। এ দুটি ফাঁড়িও অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। এর কারণ জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান যুগান্তরকে বলেন, থানার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে ফাঁড়ি। তাদের নিজস্ব জনবল বরাদ্দ আছে। তাদের আরেকটু ভালো কাজ চাচ্ছেন কমিশনার স্যার। ফাঁড়িগুলোতে জনবল সংকট সমাধান হলে ও লজিস্টিক সাপোর্ট যেমন-আলাদা গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হলে আরও গতিশীল হবে।