চট্টগ্রামে ৫ আগস্ট-পরবর্তী মামলার তদন্তে ধীরগতি
গ্রেফতার আতঙ্কে নিরপরাধ ব্যক্তিরাও * মামলা পুঁজি করে সুবিধা নিতে তৎপর অসাধু চক্র
চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর প্রায় দেড়শ মামলা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা, হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে যেমন মামলা হয়েছে, তেমনই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগেও হয়েছে। এসব মামলায় ৬ হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে। একেকটি মামলায় ৫০ থেকে দুই হাজার আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় অপরাধীর চেয়েও বেশির ভাগ নিরপরাধ মানুষকে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে সমালোচনারও শেষ নেই। সরকার, এমনকি পুলিশের তরফ থেকেও এটি স্বীকার করা হচ্ছে। নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেফতার বা হয়রানি না করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে-এমন কথা স্বয়ং পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বিভিন্ন ব্রিফিংয়ে বলছেন।
এরপরও আলোচ্য মামলার তদন্তে ধীরগতির কারণে নিরপরাধ ব্যক্তিরা আতঙ্কে আছেন। গ্রেফতারের ভয়ে অনেকে এলাকায় যেতে পারছেন না। আসতে পারছেন না প্রকাশ্যে। ফেরারি ও দুর্বিষহ জীবন পার করতে হচ্ছে তাদের। মামলা ঝুলে থাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, একশ্রেণির অসাধু পুলিশসহ বিভিন্ন পক্ষ আসামিদের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সুবিধা নিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। হচ্ছে বড় ধরনের আর্থিক বাণিজ্যও। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রয়োজনে বিশেষ সেল করে প্রকৃত অপরাধীরা যাতে চিহ্নিত হন এবং নিরপরাধ ব্যক্তিরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, মামলা বাণিজ্য যাতে বন্ধ হয়, এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। না হলে আইনের শাসন সুদূরপরাহত হয়ে পড়বে। সমাজে শান্তি ফিরবে না।
অন্যদিকে চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো আদালতে করা একটি মামলা রোববার প্রত্যাহার করা হয়েছে। মোশাররফ হোসেন লিটন নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে একজন সাবেক এমপি, সাংবাদিকসহ ৬৮ জনকে আসামি করে করা মামলাটি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের দায়িত্বে থাকা বিচারক কাজী শরীফুল ইসলাম বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খারিজের আদেশ দেন। ওই মামলাটি করার পর সিএমপির পাঁচলাইশ থানাকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর আগে চট্টগ্রাম আদালতে মামলা করতে আসা এক ব্যক্তি বিচারকের জেরার মুখে পড়েন। অচেনা বক্তিদের আসামি করার বিষয়ে জবাব দিতে না পারায় আদালত তার মামলাটি না নেওয়ায় আইনজীবীরা বিচারকের সঙ্গে বচসায় জড়ান। এর প্রতিবাদে বিচারক এজলাস ত্যাগ করার ঘটনাও ঘটে।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার বিভিন্ন থানায় গণহারে মামলা হতে থাকে। সবচেয়ে বেশি মামলা হয় নগরীর থানাগুলোয়। বহদ্দারহাট, নিউমার্কেট মোড়, ষোলশহর দুই নম্বর গেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভা-সমাবেশে হামলা, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন তাণ্ডবের ঘটনায় যেমন মামলা হয়, তেমনই নাসিমন ভবনে বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর, চট্টগ্রাম আদালত ভবনে আইনজীবী হত্যা, গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায়ও মামলা হয়েছে। নগরী ও জেলার থানাগুলোয় করা প্রায় দেড়শ মামলায় ৬ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এর বাইরে আদালতেও বেশকিছু মামলা করা হয়েছে।
কোনো কোনো মামলা সরাসরি এজাহার হিসাবে গণ্য করার জন্য থানা পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আবার কোনো কোনো মামলা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য থানা পুলিশ, পিবিআই, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে করা এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের প্রায় সব আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য, সাবেক পুলিশ কমিশনার, পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ বা অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পদে থাকা নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। জেলায় সংঘটিত ঘটনায় নগরীর বাসিন্দা এবং নগরীতে সংঘটিত ঘটনায় জেলার বাসিন্দা এমনকি প্রবাসে থাকা ব্যক্তি, ঘটনার সময় চিকিৎসার জন্য বিদেশ থাকা ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে। মামলা নিয়ে একটি মহল হোয়াটসঅ্যাপে এজাহারের খসড়া কপি পাঠিয়ে বাণিজ্য করেছে।
নাসিরুল আলম নামে বন্দর থানা এলাকার বাসিন্দা আমেরিকা প্রবাসী এক ব্যক্তি যুগান্তরকে জানান, তিনি আমেরিকা থাকেন ৩০ বছরেরও বেশি সময়। দেশে এসেছেন ৬ মাসের জন্য। তাকে কোতোয়ালি থানার একটি মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাইফুদ্দিন হাসান টিটু নামে পটিয়া উপজেলার নাইখাইন গ্রামের এক বাসিন্দা যুগান্তরকে জানান, তাকে ৩টি মামলায় জড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে বেনামি অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে পুলিশ হেডকোয়ার্টারসহ বিভিন্ন দপ্তরে। কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও কেবল রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে এসব করা হচ্ছে। মামলার কারণে নিজ এলাকায় যাচ্ছেন না। একই উপজেলার লড়িহরা গ্রামের বাসিন্দা শাহেদ উদ্দিন সুমন বলেন, পটিয়ায় ৪ আগস্ট হামলার একটি ঘটনায় ৫টি মামলায় সহস্রাধিক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। একটি মামলার এজাহারে তাকেও আসামি করা হয়েছে। অথচ তিনি ৪ আগস্ট পটিয়াতেই ছিলেন না।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) হুমায়ুন কবির বলেন, নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। স্বয়ং আইজিপিও এমন নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। তবে অপরাধীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। অপরাধীদের কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। মামলাগুলোর তদন্ত যাতে দ্রুত শেষ করা হয়, এ বিষয়েও থানার ওসি ও মামলার আইওদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। তাই মামলার আসামি হলেও সাধারণ ও নিরপরাধ লোকজনের কোনো ভয় নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, মামলাগুলোর ব্যাপারে প্রয়োজনে বিশেষ মনিটরিং সেল করে তদন্তকারী কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া উচিত দ্রুত তদন্ত শেষ করতে। অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি নিরপরাধ ব্যক্তিদের নিস্তার দিতে হবে। এসব মামলা যত বেশিদিন ঝুলে থাকবে, তত বেশি সুবিধাবাদী চক্র তা নিয়ে বাণিজ্য করবে।