সিজিএসের সংলাপ
ভালো রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় না এলে কোনো সংস্কার কাজে আসবে না
রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন ছাড়া পুলিশ সংস্কার কার্যকর হবে না
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের বাস্তব পরিবর্তন ও সংস্কার শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই সম্ভব এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় সমর্থন ছাড়া পুলিশ সংস্কার কার্যকর হবে না। এছাড়া ভালো রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় না এলে কোনো সংস্কার কাজে আসবে না। তাই এমনভাবে সংস্কার উদ্যোগ নিতে হবে যাতে কেউ ক্ষমতায় এসে ফের স্বৈরাচার হওয়ার সাহস না করে। জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান করে ক্ষমতাচ্যুত করবে-যেন এমন ভয় কাজ করে। শনিবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ : আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এই সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। পরে সিজিএসের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। সংলাপের সূচনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সুশাসনের অভাব। সংস্কারের কথা আমরা অনেক শুনি, কিন্তু বাস্তবতার আড়ালে সংস্কার এখন এক ধরনের ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সাধারণ মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পারছে না। জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছে না, পুলিশ মনোবল হারিয়ে ফেলেছে এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আলোচনায় অংশ নিয়ে মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সামগ্রিকভাবে সংস্কার করতে হবে, শুধু পুলিশের ক্ষেত্রেই নয়। কমিশনের সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন ছাড়া কার্যকর করা সম্ভব হবে না বলেও উল্লেখ করেন মুনীরুজ্জামান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। পুলিশের মনোবল ও মানসিক স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের প্রশিক্ষণ আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও উন্নত করা প্রয়োজন। এছাড়া জনগণেরও পুলিশের কার্যক্রমে সহায়তা করতে হবে, যাতে জনগণ পুলিশকে একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখতে পায়।
বিএনপির উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, বিগত সরকারের কিছু মন্তব্যের ফলে মনে হয়েছে যে, ক্ষমতায় না থাকলে দেশে বড় ধরনের সহিংসতা ঘটবে এবং পুলিশের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এটা পরিহার করতে হবে এবং পুলিশের কাজ সেবা প্রদান করা। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, এটা বুঝতে পারা যে পুলিশ সেবামূলক কাজ করতে আসে। তিনি আরও বলেন, পুলিশ এখনও ট্রমার মধ্যে আছে। আগের সরকারের পতনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিএনপিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের পুলিশের সেবা ও পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ এর মধ্যে যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে।
এসময় সাবেক আইজিপি এম এনামুল হক পুলিশের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের আদেশের বিরুদ্ধে বলার সাহস যদি না থাকে, তবে পুলিশ বাহিনী সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না। আগে যেসব কমিশন গঠন করা হয়েছিল, তার প্রয়োগ হয়নি। তাই এবার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে মানবাধিকারকর্মী সাইমি ওয়াদুদ বলেন, পদায়ন, পদোন্নতি ও সুপারিশসহ সংস্কারের সব পর্যায়ে বিরাজনীতিকরণ করতে হবে। না হলে নতুন পুলিশ সংস্কার কমিশনও জনগণের দাবি ও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না। এটা আরেকটা রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হয়ে যাবে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য ও ছাত্র প্রতিনিধি মো. জারিফ রহমান বলেন, পুলিশ ও জনগণের মধ্যে এক ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষত ২০১৮ সালের গণঅভ্যুত্থানে। পুলিশ তার ভুল স্বীকার করলেও দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর বিকেন্দ্রীকরণেও জোর দেন।
সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, স্কুল পর্যায়ে পুলিশি কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে এবং সাংস্কৃতিক আত্মস্থকরণ প্রয়োজন। পুলিশকে ‘হেনস্তাকারী’ হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে এবং ট্রাইবালিজম বা গোত্রতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পুলিশি পদোন্নতির জন্য অধিকাংশ সময় উপরের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়, যা সংস্কারের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও ব্যবসায়ী নেতা একে আজাদ বলনে, ৫২ থেকে এই পর্যন্ত পুলিশের তুলনা করে দেখেন তার উন্নতি হয়েছে নাকি অবনতি? পুলিশকে এই পর্যায়ে কে নামিয়ে গেল? এগুলো রাজনৈতিক দলগুলো করে থাকে। পুলিশকে অমানবিক কাজে নিয়োজিত করা যাবে না। র্যাবকে বিলুপ্তি করতে হবে। এগুলো না করলে এটি চলতেই থাকবে।
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠাতারা রাষ্ট্র তা তারা বুঝতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলো আর্টিকেল ৭ এর মধ্যে আটকিয়ে আছে। এই রাষ্ট্রতে জমিদারি অবস্থা, ধাওয়া-পালটাধাওয়া এখনো চলছে। এখান থেকে বের হতে হবে। আমাদের এ দেশের নাগরিক হতে হবে, বাসিন্দা নয়।
ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ভালো রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় না এলে কোনো সংস্কার কাজে আসবে না। তাই এমনভাবে সংস্কার উদ্যোগ নিতে হবে যাতে কেউ ক্ষমতায় এসে স্বৈরাচার হওয়ার সাহস না করে। জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে ছাত্র-জনতা ফের অভ্যুত্থান করে ক্ষমতাচ্যুত করবে যেন এমন ভয় কাজ করে। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধান বিশ্বের যে কাউকে দেন, দারুণ সংবিধান! কিন্তু আমি মনে করি, ভালো রাজনীতিবিদ আনার জন্য আপনারা সেমিনার করেন। আজ আপনারা এই কথা বলছেন, আই ডু রেসপেক্ট। যদি শেখ হাসিনা সরকার টিকে যেত? এই সেমিনার কি হতো? আমরা যখন মার খেতাম, ছাত্রদের যখন এই আন্দোলনের আগে ধরে নিয়ে যেত? ছাত্রদল বা জামায়াত করলেই মৃত্যুটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। ও জামায়াত করে, ও ছাত্রদল করে, ও তো মারা যাবে? ওকে তো ধরা হবেই। তখন কিন্তু আমরা সেমিনার হতে দেখিনি।
তিনি আরও বলেন, হেফাজতের বাচ্চাদের যখন কান ধরে উঠবস করাত-সেই সময় কিন্তু আমাদের গায়ে লাগেনি। গায়ে লেগেছে যখন নর্থ-সাউথ আর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে গোলাগুলি হয়েছে। কেন? সেখানে আমার ভাইবোনরা পড়ে। সুশীলদের তখন গায়ে লেগেছে। জাতি হিসাবে আমরা সেলফিশ।
আলোচনায় শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রেজওয়ানা রশীদ বলেন, পুনর্গঠন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা রাতারাতি সম্ভব নয়। পুলিশে শিক্ষা সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত এবং কমিউনিটি পর্যায় থেকে কাজ শুরু করতে হবে। পুলিশের কার্যক্রম স্বাধীনভাবে চালানোর জন্য বিচার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। তিনি বলেন, পুলিশ ও বিচার বিভাগকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়।
গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন এখন খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে উল্লেখ করে সিজিএসের চেয়ারম্যান মুনিরা খান বলেন, ব্রিটশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যায়কারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং পুলিশকে ব্যবহারের জন্য বিচার বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন-বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষক সাফকাত মুনির, আইনজীবী রাশনা ইমাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম ও শিক্ষার্থী কাজী রাকিব হোসেন প্রমুখ।