সমীক্ষা ছাড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প
ছয় বছরেও বাস্তবায়ন অগ্রগতি ১৫ শতাংশ
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
প্রকল্প তৈরিতেই ছিল গলদ। ফলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা। সম্ভাব্য সমীক্ষা ছাড়াই নেওয়া হয়েছিল এক হাজার ২২২ কোটি ৩৯ লাখ টাকার প্রকল্প। এর ফল হিসাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিরাজ করছে ধীরগতি, আছে নানা অনিয়মও। ‘চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন’ প্রকল্পে এমন বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে।
এদিকে ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি আরও কম, অর্থাৎ ৭ শতাংশ। এ কারণে নতুন করে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় নতুন করে প্রকল্পটির দ্বিতীয় আন্তঃঅঙ্গ সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়। এটি নিয়ে ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। কিন্তু সেখানে নানা প্রশ্নের মুখে পড়েন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। অবশেষে অনুমোদন না দিয়ে প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে ফেরত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আব্দুর রউফের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের শুরুতেই সমস্যা ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত নানা জটিলতা তৈরি হয়। প্রকল্পে শেষ পর্যায়ে এসে আন্তঃঅঙ্গ সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে নতুন নতুন কার্যক্রম যুক্ত করার কথা বলা হয়। তবে এ বিষয়ে তারা সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। ফলে পিইসি সভা থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পে নতুন কাজ যুক্ত করতে হলে সংশোধন করতে হবে। এভাবে অঙ্গ সমন্বয়ের নামে নতুন কাজ যুক্ত করার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তাবটি ফেরত দেওয়া হয়েছে। এখনো তারা ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়নি।
পিইসি সভা সূত্র জানায়, পরিকল্পনা কমিশন সভায় বলেছিল একই প্রকল্পের ক্ষেত্রে সংশোধন, একাধিকবার মেয়াদ বৃদ্ধি এবং একাধিকবার আন্তঃঅঙ্গ সমন্বয় কাম্য নয়। এ বিষয়ে সভায় প্রশ্ন তোলা হয়। প্রস্তাবটি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের শিক্ষা অনুবিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির সর্বশেষ অনুমোদিত মেয়াদকাল ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারিত রয়েছে। এরমধ্যে একবার সংশোধন, একবার আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় এবং দুবার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই প্রকল্পের ক্ষেত্রে এত কিছু কাম্য নয়। প্রকল্পের শেষপর্যায়ে এসে দ্বিতীয়বার আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাবের যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা করা উচিত। এছাড়া দ্বিতীয়বার আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাবের আরডিপিপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর প্রথম আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় করা হয়। সে সময় আরডিপিপিতে (সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব) ১৮টি নতুন অঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ২০২২ সালের জুনে জারি করা সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রকল্পের শুধু অনুমোদিত অঙ্গগুলোর জন্য সংস্থান করা মোট প্রাক্কলিত ব্যয় অপরিবর্তিত রেখে অঙ্গগুলোর ব্যয় যৌক্তিক পরিমাণে বাড়া বা কমানো যায়। অঙ্গগুলোর পরিমাণ এবং সংখ্যার কোনো পরিবর্তন করা যায় না। সংশ্লিষ্ট ধারার ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রথম আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয়ের সময় ১৮টি নতুন অঙ্গ আরডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সভায় এর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। কিন্তু সন্তোষজন জবাব আসেনি।
জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ যুগান্তরকে বলেন, সমীক্ষা ছাড়া এত টাকার প্রকল্প গ্রহণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর ফল হিসাবেই বাস্তবায়ন পর্যায়ে এমন অবস্থা বিরাজ করছে। এক্ষেত্রে শুধু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেই দায়ী করা যায় না। ওই সময় পরিকল্পনা কমিশন কেন সমীক্ষা ছাড়াই এটি অনুমোদনের সুপারিশ দিয়েছিল। সুতরাং তারাও দায়ী। পরিকল্পনা কমিশনের উচিত বিষয়টি কঠোরভাবে দেখা। এখানে কারও গাফিলতি থাকলে সেটি খুঁজে বের করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে অবশ্যই মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা আছে। কেননা গত ৬ বছরে ডলারের দাম অন্তত দেড়গুণ বেড়েছে। বাজারে নির্মাণ সামগ্রীর দামও প্রায় দেড়গুণ বেড়েছে। নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হলে এখন বাড়তি অর্থ গচ্চা যেত না।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের দ্বিতীয় আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাবে কিছু অঙ্গ যেমন, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, পিআইইউ কর্মচারীদের সাকুল্যে বেতন, আপ্যায়ন ব্যয়, প্রিন্টিং ও বান্ডিং, অন্যান্য মণিহারি, সম্মানি, মোটরযান বা ভেহিক্যাল এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। চলতি বছরের এ সব অঙ্গের বাস্তব ও আর্থিক অগ্রগতি এবং প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। এছাড়া এর আগে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ দ্বিতীয় আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অপ্রত্যাশিত ব্যয় অঙ্গটি আরডিপিপি থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে ৭ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনে একটি চিঠি দেয়। কিন্তু প্রস্তাবিত আরডিপিপিতে (সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব) অপ্রত্যাশিত ব্যয় অঙ্গে থেকে ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় অন্যান্য অঙ্গে স্থানান্তর করা হয়েছে। অনুমোদিত মূল ডিপিপি, অনুমোদিত প্রথম সংশোধিত উন্নয়ন প্রস্তাব (আরডিপিপি) এবং অনুমোদিত প্রথম আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় ডিপিপিতে ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও কনফারেন্সের সংখ্যা ছিল ৫টি। কিন্তু দ্বিতীয় আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাবের পরিমাণ ৫টির পরিবর্তে ১০টি করা হয়েছে। এটিও ঠিক হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং দেশে-বিদেশে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাকরি বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রকৌশল ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ তৈরির জন্য চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগে একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন করা হবে। এটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ব্যয় করা হবে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর একনেক সভায় অনুমোদন পায়। পরে মন্ত্রণালয় ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুনে প্রথমবার বৃদ্ধি করা হয়। এরপর প্রচলিত আইবাসের নতুন ইকনোমিক কোড অন্তর্ভুক্তি, বিভিন্ন অঙ্গে কোডে ব্যয় সমন্বয়সহ প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে সমাপ্তির জন্য ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী অনুমোদন দেন। এরপর প্রকল্পের আওতায় একটি বিভাগের প্রকল্প এলাকা পরিবর্তনসহ ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া দেরি হওয়ায় পরিকল্পনা কমিশন ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই প্রকল্পের দ্বিতীয়বার ৩ বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করে।