বিজেএমসিতে অস্থিরতা
অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে শাস্তির মুখে ১২ কর্মকর্তা

রফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-6761e87702f68.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনে (বিজেএমসি) কাটছেই না অস্থিরতা। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে শুরু হয়েছে বদলি আতঙ্ক। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের অনিময়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ইতোমধ্যে ১২ জনকে বদলি করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে কারণ দর্শানোর নোটিশ। মোদ্দাকথা, বদলি আতঙ্কে আন্দোলনে যুক্ত আরও অনেকের ঘুম হারাম।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, মিলগুলো বন্ধ ঘোষণার পর বিজেএমসির মিলসগুলোর মেশিনারিজ বিক্রি, জমি ও কারখানা লিজ দিয়ে ফায়দা লুটছেন সুবিধাভোগীরা। তাই এসব অনিয়মের প্রতিবাদকারীদের বদলি করা হচ্ছে। তবে সংক্ষুব্ধদের এমন অভিযোগ মানতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারি চাকরিতে বদলি একটা রুটিনওয়ার্ক। জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ যুগান্তরকে বলেন, বিজেএমসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেক দাবি রয়েছে। তাদের দাবিগুলো সম্পূর্ণ যৌক্তিক। এ বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই। তবে চাকরিতে বদলি বিষয়টি রেগুলার প্রসেস। একজন হেড অফিসে চাকরি করলে অন্য কোথাও যেতে পারবেন না, বিষয়টি তেমন নয়। তবে তাদের বদলির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নয়। মন্ত্রণালয় থেকে এমন সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়নি। এটা সম্পূর্ণ বিজেএমসির অভ্যন্তরীণ বিষয়। কারও কারও বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ ছিল, তা তদন্ত করে দেখতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিজেএমসির মিলগুলো বন্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত কার? এই মিলসগুলোর অথরিটি কে? মিলগুলো কিন্তু আমার সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়নি। সরকারের সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়েছে। এগুলো কিন্তু আপনাদের বুঝতে হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছাড়ে আওয়ামী সরকার। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনায় দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এমন অবস্থায় নিজেদের অধিকার আদায়ে সরব হন বিজেএমসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বকেয়া বেতন দাবি, জুটমিল চালু, সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও মিলগুলোর মেশিনারিজ স্ক্র্যাপ হিসাবে বিক্রির প্রতিবাদ করেন তারা। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিবের পদত্যাগও দাবি করা হয়। তারা সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে দেন স্মারকলিপি। দাবি তোলেন পুনরায় জুটমিল চালুর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানে কর্তাদের অনিময়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় ইতোমধ্যেই ১২ জনকে বদলি করা হয়েছে। এসব বদলির ক্ষেত্রে পদোন্নতির তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও অনেককে বদলির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না-সে মর্মে দেওয়া হয়েছে কারণ দর্শানোর নোটিশ।
ভুক্তভোগীরা বলছে, পাটশিল্প পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারের এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ২০১৯ সালে বিজেএমসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. আব্দুর রউফকে। তিনি ২০২০ সালে করোনাকালে এক চিঠিতে বন্ধ করে দেন রাষ্ট্রীয় ২৬টি পাটকল। পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০২১ সালে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসাবে নিয়োগ পান তিনি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বন্ধের পর বিজেএমসির মিলসগুলো মেশিনারি বিক্রি, জমি ও কারখানা লিজ দিয়ে ফায়দা লোটা শুরু হয়। মিলসের স্ক্র্যাপ মালামাল বিক্রিতে শুরু হয় হরিলুট। দুই বছর আগেও যে মেশিনগুলোতে উৎপাদন হতো-সেগুলোকে স্ক্র্যাপ হিসাবে বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিজেএমসির মিলগুলোর স্ক্যাপ মালামাল ৪৭ কোটি সাত লাখ ৯০ হাজার টাকা বিক্রির অনুমোদন দেয় বিজেএমসির পর্ষদ।
বিজেএমসির বদলি হওয়া কর্মকর্তারা বলছেন, জুট মিলসের সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলাই তাদের অপরাধ। কেন বললেন এবং সমস্যা তুলে ধরলেন? কেন প্রধান উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলেন? অভিযুক্তরা নিজেদের রক্ষা করতে আমাদের বদলি করছে। কেউ যেন আর কথা না বলে এজন্য বদলির অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে উপব্যবস্থাপক (সেবা) ইশরাত জাহান যুগান্তরকে বলেন, যৌক্তিক দাবি নিয়ে আমরা উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে দাবিগুলো উপস্থাপন করেছিলাম। কিন্তু উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলাই কাল হয়েছে।
বিজেএমসির জনসংযোগ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক সীমা দাস যুগান্তরকে বলেন, দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। অথচ বিজেএমসিতে এখনও বৈষম্য চলছে। বিগত দিনে যারা বেশি সুবিধা ভোগ করছে, এখনই তারাই সুবিধা পাচ্ছে।
তিনি বলেন, পদোন্নতির তকমা দিয়ে আমাকে বদলি করা হয়েছে। অথচ বিজেএমসিতে এমন অনেকেই আছে, যারা চাকরিতে যোগদানের পর ১৫ বছর ধরে বিজেএমসিতেই রয়েছেন। এমন অনেকে পদোন্নতি পেয়েছেন, যারা জুটমিল কি তাই জানেন না। তাদের কেন বদলি করা হচ্ছে না? তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
আন্দোলন করে যারা শাস্তির মুখে : শীর্ষ কর্তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে শাস্তির মুখে বিজেএমসির ১২ কর্মকর্তা। তারা হলেন-বিজেএমসির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ নাদিরুজ্জামান, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কেএম তানজিলুর রহমান, জনসংযোগ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক সীমা দাস, উপমহাব্যবস্থাপক (যান্ত্রিক) ইঞ্জি. শুভেন্দ্র কুমার ঘোষ, উপমহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন) আবু শাহা মণ্ডল, উপমহাব্যবস্থাপক (হিসাব/অর্থ) আলী আশরাফ, উপব্যবস্থাপক (উৎপাদন) কাজী মামুন হোসেন, উপব্যবস্থাপক (উৎপাদন) রুপেন চন্দ্র দে, উপব্যবস্থাপক (সেবা) ইশরাত জাহান, উপব্যবস্থাপক (হিসাব/অর্থ) মো. দেলোয়ার হোসেনকে বিভিন্ন মিলে বদলি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালে ৭৮টি মিল নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বিজেএমসির লক্ষ্য ছিল উন্নতমানের পাটজাত পণ্য উৎপাদন, পাটজাত পণ্যের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে নিয়ন্ত্রণ, শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কৃষকদের পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। তবে আর্থিক ক্ষতি ও শ্রমিক অসন্তোষ দেখিয়ে ২০২০ সালের জুলাইয়ে বিজেএমসির ২৬টি মিলসের উৎপাদন একযোগে বন্ধ করে সরকার। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানের কমকর্তা-কর্মচারীদের ২ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে। এর আগে বন্ধের পর মিলের মেশিনারিজ বিক্রির অর্থ দিয়ে ৪ বছর বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়।