সফটওয়্যার অটোমোশনে নতুন জটিলতা
ভূমি সেবায় মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি
লালবাগের স্থায়ী বাসীন্দা রুহুল আমিন। জুলাইয়ে ছোট ছেলের ব্রেন টিউমার ধরা পড়লে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে বলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু নগদ টাকা না থাকায় জমি বিক্রি করতে গিয়ে পড়েন ভোগান্তিতে। নামজারি করতে গত ২ সপ্তাহে ৩ দিন ভূমি অফিসে গিয়ে কাজ করতে পারেননি। শুধু রুহুল আমিন নয়, ভূমিসংক্রান্ত সমস্যায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ভোগান্তিতে আছেন অসংখ্য মানুষ। বর্তমানে নামজারি, পর্চা, খাজনার রসিদ কাটতে না পারায় জমি কেনাবেচা অনেকটা বন্ধই আছে। তবে এ সপ্তাহে সমস্যা পুরোপুরি শেষ হবে বলে আশাবাদী সফটওয়্যার প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতা ও ভূমি অফিসের কর্মীরা বলছেন, অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর ও নামজারি সেবায় দ্বিতীয় প্রজন্মের সফটওয়্যার চালুর পর থেকে নতুন এ ভোগান্তি শুরু হয়েছে। ১ ডিসেম্বর নতুন সফটওয়্যার চালুর আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করায় প্রতিদিনই নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে গত ২০ দিনে সেবাগ্রহীতাদের সীমাহীন ভোগান্তি ছাড়াও সরকারের রাজস্ব আদায় কমেছে কয়েক গুণ।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভূমিসংক্রান্ত কাজে দ্রুতগতি আনতে ৫টি সফটওয়্যার একত্রিত করে মান উন্নীত করা হয়েছে। ১ ডিসেম্বর ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় ৪টি সফটওয়্যারের মানোন্নয়ন এবং একটি নতুন উদ্ভাবিত সফটওয়্যার জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করেন ভূমি উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, ২৪ নভেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ই-মিউটেশন সিস্টেম, ই-পর্চা সিস্টেম এবং ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম বন্ধ থাকবে। ১ ডিসেম্বর থেকে এই সেবা পুনরায় চালু করা হবে। তবে ১ ডিসেম্বর নতুন সফটওয়্যার চালু হলেও বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হওয়ায় গ্রাহকরা ব্যবহার করতে পারছেন না।
রাজধানীর ভূমি অফিসের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, দ্বিতীয় প্রজন্মের এ সফটওয়্যার চালুর পর থেকেই জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। এ সফটওয়্যার চালুর আগে টেস্টিং ও ইন্টিগ্রেশনের চেকলিস্ট সম্পন্ন করা হয়নি। সিস্টেম চালুর আগে কোনো কারিগরি টিম তৈরি বা তাদের ফিডব্যাকও নেওয়া হয়নি।
প্রজেক্ট অফিসের একক সিদ্ধান্তে সিস্টেমটি চালু করা হয়েছে। যার কারণে চালুর পর থেকেই নানা ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নতুন সার্ভারে জমিসংক্রান্ত তথ্য আপলোড দিলে নিচ্ছে না। সত্যতা যাচাই করতে গেলে সঠিক ফলাফল দেখাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও বলেন, প্রতিটি এসি ল্যান্ডের কার্যালয়ে গড়ে দেড় থেকে তিন হাজার নামজারি পর্চা ও খাজনা পরিশোধের পুরোনো আবেদন জমা হয়ে আছে। ২৬ নভেম্বরের আগে করা এসব আবেদন পুরনো সফটওয়্যারের কার্যক্রম বন্ধ করায় মীমাংসা করা যাচ্ছে না। কোন প্রক্রিয়ায় এগুলো মীমাংসা করা হবে তারও কোনো নির্দেশনা নেই। নতুন সফটওয়্যারেও এগুলো মীমাংসা করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৭০ জন পুরোনা নামজারি, পর্চা ও খাজনা পরিশোধের আবেদন নিয়ে আমাদের অফিসে আসছেন এগুলো সমাধানের জন্য। বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে।
পল্টন এলাকার ভূমি ব্যবসায়ী দিদার আহমেদ বলেন, শুধু ঢাকা নয়, দেশের সব ভূমি অফিসেই নামজারি পর্চা ও খাজনা পরিশোধ বন্ধ থাকায় নতুন ভূমি রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে না। এ কারণে জমি কেনাবেচা প্রায় বন্ধই বলা যায়। ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন সফটওয়্যার চালু হয়েছে বলা হলেও কাজ করতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। ভূমি অফিসগুলো থেকে কখনো সার্ভার ডাউন, কখনো সার্ভার কাজ করছে না-এমন কথা বলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
গত কয়েক দিন ধরে তেজগাঁও ভূমি অফিসে নামজারি কাজে আসছেন হাসান শাহরিয়ার। তিনি বলেন, নামজারির কাজে এসি ল্যান্ড অফিসে সাক্ষাৎ করলে সার্ভার সমস্যার কথা জানানো হয়। তবে কবে নাগাদ এ সমস্যা ঠিক হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। এর আগেও দুবার এসে কাজ করতে না পেরে ফিরে গেছেন তিনি।
গত কয়েকদিন রাজধানীর একাধিক ভূমি অফিসে সরেজমিন দেখা গেছে, নামজারি ও খাজনা পরিশোধ নিয়ে সব থেকে বেশি বিপদে পড়েছেন জটিল রোগে আক্রান্ত ও বিদেশগামীরা। ক্যানসার, কিডনি, ফুসফুস ও হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে পারছেন না। জমি বিক্রি করতে না পেরে কীভাবে বিপুল অঙ্কের টাকা জোগাড় করবেন সেই চিন্তায় দিশেহারা। অনেকের বিদেশে যাত্রাও থেমে আছে। আবার অনেকের ভিসার মেয়াদও শেষের পথে। নামজারি পর্চা ও খাজনা দিতে না পারায় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক লোন যেমন পাচ্ছেন না, তেমিন খাজনা আপডেট করতে না পারায় রাজউক থেকে ইমারত নির্মাণের অনুমোদন, বিদ্যুৎ সংযোগ ও পানির সংযোগের অনুমতি মিলছে না বলে অভিযোগ অনেকের।
ঢাকার লালবাগ, তেজগাঁও ও রমনা বিভাগের সহকারী কমিশনারের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের এ প্রতিবেদকের। তারা বলেন, ৫টি সফটওয়্যারকে একটি সফটওয়্যারে অটোমেশন করার কারণে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে। তারা সমাধানে কাজ করছেন।
এ বিষয়ে ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আগের ম্যানুয়াল সিস্টেম পরিবর্তন করে ৫টি সফটওয়্যারকে একটিতে উন্নীত করা হয়েছে। অটোমেশনের কাজ করতে গিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে, যা ইতোমধ্যে সমাধান করা হয়েছে। এ সপ্তাহের মধ্যেই বাকি সমস্যরা সমধান হয়ে যাবে।