Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ

হোতা হিসাব সহকারী ইমরান এখন দুবাই * সহযোগী ডিএএফওসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা * শুধু আইনজীবীর অ্যাকাউন্টেই ১০ কোটি টাকা

Icon

মতিউর রহমান, মানিকগঞ্জ

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ

মানিকগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে অভিনব কায়দায় ভুয়া পেমেন্ট অর্ডারের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারের ৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। মূলহোতা ওই অফিসেরই হিসাব সহকারী ইমরান নাজির জালিয়াতি ফাঁসের পরই দুবাই পাড়ি জমিয়েছে।

জালিয়াত চক্রের অন্যতম হোতা জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের ডিএএফও (ডিস্ট্রিক্ট অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসার) মো. নজরুল ইসলাম ও সুপার দেওয়ান ফেরদৌস ওয়াহিদসহ মানিকগঞ্জ আইনজীবী সমিতির ৬ সদস্য ও ইমরান নাজিরের আত্মীয়স্বজনসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে সিনিয়র স্পেশাল আদালতে মামলা করেছেন দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সুজন শিকদার। এ ঘটনা কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পরই শোকজ পরবর্তীতে হিসাব সহকারী ইমরান নাজিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ধোকরাকোল গ্রামের মৃত নাজমুস সাহাদতের ছেলে ইমরান নাজির ২০১৮ সালে মানিকগঞ্জ জজকোর্টের মাধ্যমে চাকরিজীবন শুরু করেন। ইমরান তার স্ত্রী আফিফাকে বলেছিল চাকরির পাশাপাশি তার জমিজমা এবং গাড়ির ব্যবসা আছে।

এদিকে মামলাটি তদন্তের জন্য স্পেশাল জজ আদালত থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে। মামলার বাদী সুজন শিকদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

পাঁচ বছর পাঁচ মাস ধরে নজিরবিহীন এ জালিয়াতি চললেও ধরা পড়েছে নভেম্বরে। এতে যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে স্বয়ং জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মকর্তা ও সুপারের বিরুদ্ধে। তবে এ নিয়ে মন্তব্য কোনো মন্তব্য করবেন না বলে সাফ জানিয়েছেন জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের ডিএএফও নজরুল ইসলাম।

যুগান্তরের অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৮ জুলাই ২০১৯ সাল থেকে ২২ আগস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত বরখাস্ত ইমরান মানিকগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকদের স্বাক্ষর জাল করে প্রিয়েমশনসহ (অগ্রক্রয়াধিকারমূলক অধিকার হলো কোনো ক্রেতার কাছ থেকে আবার ক্রয়ের অধিকার।

শরিকের কোনো বিক্রীত জমি বহিরাগত ক্রেতার কাছ থেকে অন্য কোনো শরিক আদালতের মাধ্যমে মূল্য ও নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দিয়ে ক্রয় করাই হচ্ছে প্রিয়েমশন) চলমান ও নিষ্পত্তি বিভিন্ন মামলার ভুয়া পেমেন্ট অর্ডার তৈরি করে শতাধিক মানুষের নামে ৩২ কোটি ৬০ লাখ ৩২ হাজার ৭৬৭ টাকা আত্মসাৎ করেছে।

এ জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে ৬ নারীসহ জড়িত রয়েছে স্ত্রীর ভাই, আপন ফুপা, ভাই, ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ব্যক্তিগত গাড়িচালক, আদালত পাড়ার সুযোগ সন্ধানী ৬ আইনজীবী। শুধু ৬ আইনজীবীর অ্যাকাউন্টেই সরকারি কোষাগারের ১০ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাচার হয়েছে।

পাঁচ বছর পাঁচ মাস ধরে বিভিন্ন পারিবারিক মামলা, এনআইঅ্যাক্ট (চেক ডিজঅনার) মামলার গচ্ছিত মামলার টাকা সরকারি কোষাগার থেকে পর্যায়ক্রমে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে জজ কোর্টের হিসাব সহকারী একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে ২১ জনের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে তাদের নামের হিসাবে ২১ লাখ থেকে শুরু করে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত ভুয়া পেমেন্ট অর্ডার বানিয়ে হিসাবরক্ষণ অফিসের যোগসাজশে চেক ইসু করে ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে।

এ কাজে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের ডিএএফও নজরুল ইসলাম, একই অফিসের সুপার দেওয়ান ফেরদৌস ওয়াহিদের বিরুদ্ধে। এছাড়া ইমরানের স্ত্রীর বড় ভাই রুবেল হোসেন, বোন জামাই আবুল হোসেন, চাচাতো ভাই হাবিবুর রহমান, ইমরানের বন্ধু শরীফুল ইসলাম, বান্ধবী নিলুফা আক্তার, গাড়িচালক মো. জামাল ও ফুপা ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মুনসুর আলম, মানিকগঞ্জ আইনজীবী সমিতির ৬ জন আইনজীবীসহ ২১ জনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে।

স্বাক্ষর জালিয়াতি করে সরকারি কোষাগার থেকে ৩২ কোটি ৬০ লাখ ৩২ হাজার ৭৬৭ টাকা খোয়া যাওয়ার ঘটনায় ১লা সেপ্টেম্বর ইমরানকে শোকজ করা হয়। কর্তৃপক্ষের কাছে ইমরান স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগ স্বীকার করেন। পরবর্তীতে হিসাব শাখার ভারপ্রাপ্ত বিচারক ইমরানের কারণ দর্শানোর জবাবের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয় জানিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থার চিঠি পাঠান।

এরপরই জেলা ও দায়রা জজ আসামি ইমরানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেন। অভিযোগ গুরুতর বিবেচনা হওয়ায় ১৮ সেপ্টেম্বর ইমরানকে সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আসামির মাধ্যমে স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে কোনো আর্থিক অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে কি না তা অনুসন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ কেলেঙ্কারির বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পরপরই ইমরান দুবাই চলে যান বলে জানান তার স্ত্রী আফিফা। বর্তমানে সেখানে তিনি দোকান খুলে ব্যবসা করছেন। আফিফা আরও জানান, ইমরানের চাচাতো ভাই হাবিবুর রহমান (২০ নম্বর আসামি) এবং বন্ধু শরীফুল ইসলাম (১১ নম্বর আসামি) এর মূল হোতা। এদের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে যত টাকা তোলা হয়েছে সব তারাই নিয়ে চম্পট দিয়েছেন।

তিনি বলেন, অতিরিক্ত টাকার বিষয়ে আমি সব সময় জিজ্ঞেস করতাম ইমরান বলত চাকরির বাইরে তার জমিজমা এবং গাড়ির ব্যবসা আছে। এগুলো সব তার ব্যবসার টাকা। কিন্তু এই বিষয়গুলো আমি জানি না। আমার ভাইয়ের মাধ্যমে যত টাকা তোলা হয়েছে সব তাকে দিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমি ইমরানের অপকর্মের দায় কেন নেব? তাছাড়া হাবিবুর রহমান এবং শরীফুল ইসলাম ছাড়া তার অপকর্মের কথা কেউ জানত না।

দুদকের মানিকগঞ্জের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আজিজ উল্লাহ বলেন, আমার প্রায় ৫০ বছর আইন পেশায় কখনো শুনিনি কোর্টের টাকা আত্মসাৎ করা যায়। ঘটনাটি পুরো বিচার বিভাগকে ভাবিয়ে তুলেছে।

জেলা জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নূরতাজ আলম বাহার বলেন, এটা তো সরকারি টাকা এবং বিভিন্ন মামলা সংক্রান্ত টাকা। এ ঘটনার সঙ্গে যেসব আইনজীবীর নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে বারের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

মামলার আইনজীবী সামিউল মাহমুদ রাকিব জানান, দুর্নীতি দমন আইন, মানিলন্ডারিং ও দণ্ডবিধির বেশ কয়েকটি ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলা তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম