সিপিডির ৩০ বছর পূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টা
সিপিডি স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করেছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মনন সৃষ্টিতে সিপিডির গবেষণা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম অশেষ ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি দেশের সার্বিক চিন্তা কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। রোববার সিপিডির ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত সেমিনারে এক ভিডিও বার্তায় এসব কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। তিনি আরও বলেন, একটি গণতান্ত্রিক ন্যয়ভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সব সময় সচেষ্ট থেকেছে সিপিডি। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি আমার কাছে সব সময় বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক ইন সেন্টারে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের সামগ্রিক অবস্থার পরিবর্তন এবং আমি সারা জীবন ধরে দারিদ্র্য দূরীকরণের যে চেষ্টা করেছি, সিপিডির কাজে তার প্রতিফলন দেখেছি। বিগত ৩০ বছরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে সিপিডি নিজেদের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে পেরেছে। দেশে এবং দেশের বাইরে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। সিপিডি সব সময় স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করেছে এবং দেশের স্বার্থে নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি থেকে সিপিডি বিভিন্ন সময় নীতিসংক্রান্ত সংলাপের আয়োজন করে। যার অনেকগুলোতে আমি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকেছি।
ড. ইউনূস বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে। আমি আশা করব, সিপিডি অতীতের মতোই বর্তমান এবং আগামীতে তার বুদ্ধিভিত্তিক অবদান অব্যাহত রাখবে। দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণে অবদান রেখে যাবে।
পুরো সেমিনার পরিচালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। সেমিনারে সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, এক সময় জাতীয় সংসদ না থাকায় বাজেট নিয়ে সিপিডি পর্যালোচনা করেছে যা গুরুত্ব বহন করে। নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে আজ এখানে পৌঁছেছে। সরকারের মধ্যে সুশাসন নিশ্চিত করতে কাজ করেছে সিপিডি। তিনি আরও বলেন, জনগণ নীতি প্রণয়ন করে না, সেটি করে নীতিনির্ধারকরা যা জনগণ গ্রহণ করে। ফলে গণতন্ত্র প্রক্রিয়ায় নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সিপিডি।
সেমিনারে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, গত ১৫ বছর কথা বলতে পারিনি। কথা বললে জেল ও মিথ্যা মামলা দেওয়া হতো। তবে রাজনীতির প্লাটফর্মের বাইরে আলাদা কথা বলার স্পেস সৃষ্টি হতো সিপিডির ডায়লগে। আর সেখানে এসেই কথা বলতে পারতাম। যা রাজনৈতিক নিয়মকানুনের বাইরে গিয়ে ন্যায়সংগত কথা বলা যেত। তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর দেশের মানুষের মনোজগতে বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন মুক্ত, স্বচ্ছ, অবাধ পরিবেশ চাচ্ছে সবাই। এমন প্রেক্ষাপটে সংস্কার করছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে যে কোনো সংস্কার রাজনৈতিক ও গণতন্ত্র প্রক্রিয়ায় করতে হবে। পাশাপাশি সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। হঠাৎ কয়েকজন মিলে মনে করলেন সংস্কার করে বাংলাদেশকে ঠিক করে দেবেন-এটি ঠিক নয়। যে সংস্কার হচ্ছে তা সাধারণ মানুষকেও ধারণ করতে হবে। কারণ বিগত সময়ে এককভাবে করতে গিয়ে টিকতে পারেনি। ওই সময় মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আর ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে অটোমেটিক অন্য অধিকারগুলো চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, নির্বাচনই শেষ নয়, গণতন্ত্রকে টেকসই করতে চাইলে সংস্কার ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। ফলে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সংস্কার হলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে। মুক্ত ও অবাধ পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
সেখানে অধ্যাপক ড. রওনক জাহান বলেন, সুশাসনের ওপর সিপিডি বেশি জোর দিয়ে আসছে। যে কোনো সংকটকালে যখন জাতীয় সংসদ কাজ করে না ওই সময় সিপিডি একটি পৃথক স্পেস তৈরি করেছে এবং সরকারকে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনার কাজটি করেছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকট এলে বিভাজনের রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে নিয়েছে এ সংস্থা।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান ক্রান্তিকালে বৈষম্য নিরসণের কথা বলছেন সবাই। বর্তমান যে সরকার আছে এবং আগামীতে ক্ষমতায় যারা আসবেন সমাজে বৈষম্য দূর করতে সিপিডির গবেষণা ও তথ্য ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়ে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি নির্ভয়ে কাজ করতে পারে তারও নিশ্চয়তা চাওয়া হয়।
ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, বছরের পর বছর প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কথা বলেছে সিপিডি। ১৯৯১ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর চিন্তাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সিপিডির যাত্রা শুরু হয়। গত ১৫ বছর মুক্তচিন্তাকে আওয়ামী লীগ সরকার আঘাত করেছে। তিনি আরও বলেন, সরকার পতনের অন্যতম কারণ মিডিয়ার গলা টিপে ধরা। মিডিয়ার স্বাধীনতা দিলে সত্যটা সামনে আসত। সে সত্যটাকে ধরে পদক্ষেপ নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়টি পরে। কিন্তু গলা টিপে ধরার কারণে সত্য সামনে আসতে পারেনি।
আলোচনায় আরও অংশগ্রহণ করেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার নিহাদ কবির, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির প্রেসিডেন্ট তাসলিমা আক্তার লিমা। অনুষ্ঠান শেষপ্রান্তে সিপিডির প্রকাশিত দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।