Logo
Logo
×

শেষ পাতা

নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পরিত্যক্ত বাড়ি হস্তান্তর

কারসাজিতে বেদখল হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন: বাড়িটি আলোচিত খুকু হত্যায় ফাঁসি কার্যকর হওয়া আসামি মনিরের * রাজউকের সাবেক প্রভাবশালী সদস্য নুরুলসহ সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত * শতকোটি টাকার ঘুস বাণিজ্য রাঘববোয়ালদের পকেটে

তোহুর আহমদ

তোহুর আহমদ

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কারসাজিতে বেদখল হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

কঠোর দাপ্তরিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বহু মূল্যবান প্লটসহ একাধিক পরিত্যক্ত বাড়ি প্রভাবশালীদের অনুকূলে বরাদ্দ দিয়েছে খোদ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ইতোমধ্যে অভিজাত গুলশান এলাকার এমন কয়েকটি বাড়িতে ঝুলছে নতুন মালিকানার সাইনবোর্ড। সেখানে এখন পুরোনো কাঠামো ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের পাঁয়তারা চলছে জোরেশোরে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজউকের আওতাধীন কয়েকটি পরিত্যক্ত বাড়ি হস্তান্তরে রীতিমতো লঙ্কাকাণ্ড ঘটে। সরাসরি কর্তৃপক্ষের মদদে সরকারি সম্পদ তছরুপের অপরাধ সংঘটিত হয়। রহস্যজনক কারণে সবকিছু জেনেও সংশ্লিষ্টদের কেউ বিষয়টি আমলে নেননি। এমনকি খোদ রাজউকের বোর্ডসভা থেকেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় অনুমোদন দেওয়া হয়।

রাজউক তার স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে এ ধরনের কোনো বিষয়ে অনুমোদন দিতে পারে কি না এমন প্রশ্ন করা হলে রাজউকের আইন শাখার পরিচালক মাহফুজুল করিম বৃহস্পতিবার তার কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, আপনার প্রশ্নের মধ্যেই এর উত্তর রয়েছে। সোজা কথায় রাজউক কোনোভাবেই তার স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এমন পদক্ষেপে সায় দিতে পারে না। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে রাজউক আরও গভীরে গিয়ে বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখতে পারে।

সূত্র বলছে, হাসিনা সরকারের আশীর্বাদপুস্ট রাজউক প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব বাড়ি হস্তান্তর করা হয়। এর মধ্যে সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) নুরুল ইসলামকে কারসাজির মূলহোতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। মূলত তার নেতৃত্বে পরিত্যক্ত বাড়ি হস্তান্তরের অবৈধ কর্মকাণ্ড কৌশলে আইনসিদ্ধকরণের চেষ্টা চলে।

প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদে তিনি রাজউকে টানা ৬ বছর গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল ছিলেন। এছাড়া রাজউকের সাবেক এক চেয়ারম্যানসহ আরও বেশ কয়েকজন রাঘববোয়াল অপকর্মে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়।

সরেজমিন : রাজউকের হস্তান্তর নিষেধাজ্ঞা তালিকার ২২ নম্বরে আছে গুলশানের ৫৯ নম্বর রোডের ২ নম্বর বাড়ি (ব্লক ব্লকএডব্লিউ-ই)। ২০ কাঠা জমিসহ বাড়িটির বর্তমান মূল্য শতকোটি টাকার ওপরে। মূল্যবান এই বাড়ির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বিরোধ চলে আসছে।

সম্প্রতি সরেজমিন বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, সীমানা প্রাচীরঘেরা জরাজীর্ণ একতলা বাড়ি। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় আগাছায় চারপাশ ঢেকে আছে। লোহার গেটেও জং ধরেছে। কিন্তু গেটের পাশে চকচক করছে পাথরের তৈরি নতুন নামফলক। এতে লেখা বাড়ির মালিক আসিফ আহমাদ।

বর্তমানে পুরোনো কাঠামো ভেঙে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। বাইরে ঝুলছে গৃহনির্মাণ কোম্পানির বিশাল সাইনবোর্ড। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বোরাক মিনারভা’।

রাজউকের বিতর্কিত সম্পত্তি তালিকার আরেকটি গুলশানের ১২৬ নম্বর রোডের ২ নম্বর বাড়ি (ব্লক সিইএস-ই)। এ প্লটটির আয়তন ১৪ কাঠা। মালিকানা দ্বন্দ্বে দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকলেও সম্প্রতি এখানেও বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে পুরোনো বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে উঁচু সীমানা প্রাচীর। ভেতরে ডিউটি করছেন কয়েকজন পোশাকধারী নিরাপত্তাকর্মী। প্লট মালিকের নাম জানতে চাইলে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, ক্যাথেরেসিস নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানি এখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করবে। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তারা এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। প্লট মালিককে তারা চেনেন না।

পাশের কয়েকজন মুদি দোকানি জানান, প্লটের মালিকানা নিয়ে গোলমাল দীর্ঘদিনের। এ কারণে মালিক হিসাবে একেক সময় একেকজনের নাম শোনা যায়। তবে এর আদি মালিকের নাম জনৈক মনির হোসেন।

প্লটসংলগ্ন ফুটপাতে সেলাই মেশিন বসিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর দর্জির কাজ করেন বিক্রমপুরের বাসিন্দা আবু সাঈদ। ২ নম্বর প্লটের মালিকানা সম্পর্কে জানতে চাইলে আবু সাঈদ বলেন, আলোচিত খুকু হত্যা মামলার আসামি মনির হোসেন প্লটের মালিক ছিলেন। কিন্তু কারাবন্দি অবস্থায় ’৯৬ সালের দিকে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। পরে মালিকানা দাবি করে একাধিক ব্যক্তি মামলা করে। এ অবস্থায় বাড়িসহ প্লটটি দীর্ঘদিন ফাঁকা পড়েছিল। সম্প্রতি এটি বিক্রি হয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গুলশানের ১৩৫ নম্বর রোডের ১ নম্বর প্লটসহ বাড়ি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসাবে রাজউকের তালিকাভুক্ত। কিন্তু এ সম্পত্তি বর্তমানে ব্যাংক খাতের আলোচিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের দখলে। সেখানে এস আলমের মালিকানাধীন ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রস্তাবিত প্রধান কার্যালয় নির্মাণের জন্য বিশাল সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছে। বাড়ির একদিকে সশস্ত্র আনসার এবং অন্যদিকে পোশাকধারী নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করছেন।

এ ছাড়া ইতোমধ্যে হস্তান্তরকৃত তালিকায় আছে গুলশানের ৯৮ নম্বর রোডের ৬ নম্বর এবং ৪৯ নম্বর রোডের (সিডব্লিউএন) ২ নম্বর বাড়ি। দুটি বাড়িই বিশাল আয়তনের প্লটে অবস্থিত। বর্তমান বাজারে এসব প্লটের মূল্য কাঠাপ্রতি অন্তত ১০ কোটি টাকা।

ফাইল গায়েব : সম্প্রতি রাজউকে গিয়ে পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দসংক্রান্ত ফাইল দেখতে চাইলে রেকর্ড রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের একজন হোল্ডিং নম্বর দেখেই আঁতকে ওঠেন। দীর্ঘসময় ধরে খুঁজেও ফাইল না পেয়ে তাদের একজন বলেন, এভাবে শত চেষ্টা করলেও ফাইল পাওয়া যাবে না। কারণ এসব কাজ কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। ফলে দাপ্তরিক সব কাজ শেষ হলেও নিয়মানুযায়ী ফাইল রেকর্ড রুমে দেওয়া হয় না।

জানা যায়, পরিত্যক্ত বাড়ি সংক্রান্ত কয়েকটি ফাইল ইতোমধ্যে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি ফাইল রয়েছে এস্টেট ও ভূমি-১ শাখার সাবেক পরিচালক (বর্তমানে জোন-৪ বদলিকৃত) কামরুল ইসলামের জিম্মায়। তার অফিসের আলমারিতে ফাইলগুলো বর্তমানে তালাবন্দি রাখা হয়েছে। পরে ফাইলের খোঁজে কামরুল ইসলামের কক্ষে গেলে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আমিনুল হুদা সাফ জানিয়ে দেন, চেয়ারম্যানের লিখিত অনুমোদন ছাড়া ফাইল দেখানো যাবে না।

নুরুল চক্র : পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দে কারসাজির নেপথ্যে ছিলেন রাজউকের সাবেক প্রভাবশালী বোর্ড সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) নুরুল ইসলাম। মূলত তার নেতৃত্বে হারানো ফাইলের বিপরীতে খোলা হয় বিশেষ ‘লুজ নথি’। এছাড়া অনিয়ম জায়েজ করতে মন্ত্রণালয় থেকেও ‘রাজনৈতিক সুপারিশ’ নেওয়া হয়। পরে চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে আদায় করা হয় বোর্ডসভার অনুমোদন। অনেকটা প্যাকেজ আকারে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে।

সূত্র বলছে, পরিত্যক্ত বাড়ি হস্তান্তর কারসাজিতে নুরুল ছাড়া রাজউকের আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে নুরুলের তৎকালীন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএ) হুমায়ুন কবির, এস্টেট ও ভূমি-২ শাখার সাবেক পরিচালক কামরুল ইসলাম, উপপরিচালক আমিরুল ইসলাম, গুলশান এস্টেট শাখার উপপরিচালক লিটন সরকার, এস্টেট ও ভূমি-৩ শাখার উপপরিচালক নায়েব আলী শরিফ এবং এস্টেট শাখার উচ্চমান সহকারী প্রবীর কুমার সরকার।

রাজউকের কর্মকর্তাদের কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, শুধু পরিত্যক্ত বাড়ি নয়, রাজউকের নানা অনিয়মের হোতা ছিলেন নুরুল ইসলাম। আওয়ামী ঘনিষ্ঠ হিসাবে তিনি টানা ৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ এস্টেট ও ভূমি শাখায় কর্মরত ছিলেন। এ সময় আইনের ফাঁক গলিয়ে নানা অনিয়ম জায়েজ করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন নুরুল।

অনিয়মের মাধ্যমে উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে বাগিয়ে নেন পাঁচ কাঠা আয়তনের ৭ কোটি টাকার প্লট (প্লট নম্বর ১৬, সেক্টর ১৬/এ, রোড নং-০৩) এছাড়া প্রমাণযোগ্য দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ এলেও দলীয় প্রভাবে রাজউকে বহাল ছিলেন নুরুল। হাসিনা সরকার পতনের কয়েক মাস আগে যুগ্মসচিব হিসাবে পদোন্নতি দিয়ে তাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।

কারসাজি ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানার জন্য রাজউকের সাবেক বোর্ড সদস্য (স্টেট ও ভূমি) নুরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে শনিবার কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম