প্রতিদিন গড়ে ৫-৭টি নষ্ট হচ্ছে
ইঞ্জিন বিকলে মিলছে না রেলে উন্নতির সুফল
ইঞ্জিন-কোচ রক্ষণাবেক্ষণসহ রোলিংস্টক দপ্তরে ৭৬ শতাংশ লোকবল স্বল্পতা
ফাইল ছবি
যাত্রীসেবা-সুরক্ষার প্রশ্নে রেলের প্রস্তুতিকে সংশয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে চলন্তাবস্থায় ইঞ্জিন বিকল (ইঞ্জিন ফেইলিউর) হয়ে পড়ার ঘটনা। এমন দিন নেই যেদিন কমপক্ষে ৫-৭টি ইঞ্জিন চলন্ত অবস্থায় বিকল না হয়। এতে দিন যত যাচ্ছে, ট্রেনের গতি কমছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনা। একটি ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় গড়ে ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ৭৭ শতাংশ ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন পরিচালনায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তবে শুধু পুরোনো নয় উদ্বেগের বিষয়, গত ১৫ বছরে যুক্ত নতুন ইঞ্জিনগুলোও চলন্তাবস্থায় যেখানে-সেখানে বিকল হয়ে পড়ছে। নিত্যদিনের এমন ঘটনায় কাউকে দায়ী করা হচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে নিম্নমানের ইঞ্জিন কেনার ফলে নতুনগুলোও সমস্যার সৃষ্টি করছে। একবার কেনার সময় দুর্নীতি হয়েছে, এখন এগুলো মেরামতের নামেও চলছে হরিলুট। এসব কারণে রেলের যে উন্নয়ন হয়েছে এর কোনো সুফল পাচ্ছে না জনগণ। রেলে বর্তমানে কাগজে-কলমে ৩০৩টি ইঞ্জিন আছে। এর মধ্যে সচল ২৩৮টি। সচল ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ৭৭ শতাংশের আয়ুষ্কাল শেষ। এসব ইঞ্জিন দিয়ে গড়ে ৬৬ শতাংশের বেশি গতি উঠানো সম্ভব নয়। এ কারণে ট্রেন পূর্ণগতিতে চলতে পারছে না। বিকল ইঞ্জিনগুলো মেরামতের নামেও ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চলন্তাবস্থায় বিকল হয়ে পড়া কোনো ইঞ্জিন মেরামতের কয়েক দিনের মধ্যেই ফের বিকল হয়ে পড়ার নজির রয়েছে। বিকল ইঞ্জিনগুলো মেরামতে গড়ে মাসখানেক সময় ব্যয় হয়। এ সময় কি মেরামত হলো, এটা কতদিন চলবে এগুলো সেভাবে তদারকি করা হয় না। এছাড়া কিছু ইঞ্জিন মেরামতে বছরের চেয়েও বেশি সময় লাগে।
বর্তমানে রেলে ৩ হাজার ১১৪.৬৬ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। খোদ রেলের পরিকল্পনা দপ্তর সূত্র বলছে, পর্যাপ্ত ইঞ্জিন-কোচ থাকলে বর্তমানে প্রায় ৮০০ ট্রেন চালানো সম্ভব। সঙ্গে বন্ধ থাকা ৭২টি ট্রেনও পরিচালনা করা যায়। রেলে উন্নয়ন গতির মধ্যে সবচেয়ে ধীরগতি ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়। আগামী ১০ বছরের মধ্যে অন্তত ৫০০ ইঞ্জিন ক্রয় করা সম্ভব না হলে কাঙ্ক্ষিত ট্রেন পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী যুগান্তরকে বলেন, রেলে হরিলুটের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে বেশ এগিয়ে। কাঙ্ক্ষিত যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইঞ্জিন-কোচসহ রোলিংস্টক সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়নি। যেসব উন্নয়ন ঘিরে দুর্নীতি-লুটপাট সহজে করা যায়-সেই উন্নয়নগুলোই করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, একটা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেই পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে ইঞ্জিন-কোচসহ রোলিংস্টক সরঞ্জাম ক্রয়ে। রেলকে গতি বাড়িয়ে আধুনিক এবং জনবান্ধব করতে হলে পর্যাপ্ত ট্রেন প্রয়োজন। চলমান রেলপথ থেকে শুরু করে রোলিংস্টক সামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণ শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। ইঞ্জিন ফেইলিউরকে কেন্দ্র করে যে অভিযোগগুলো উঠছে-দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। সময়ের ট্রেন সময়ে চলবে-না চললে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে যা যা প্রয়োজন তা শক্ত হাতে করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেলে নতুন ট্র্যাক, সিগন্যালিং ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও দুর্নীতির কারণে ভেতরের কঙ্কালসার অবস্থা ফাঁকফোকর দিয়ে ভেসে উঠছে। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা অবকাঠামো উন্নয়নে খরচ করলেও রোলিংস্টক ক্রয় করেছে মাত্র ৩৫০০ কোটি টাকার। উন্নয়ন ঘিরে হরিলুটের চিত্র ভেসে আসায় নড়েচড়ে বসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের রেলওয়ে উপদেষ্টা-সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা। রোলিংস্টক ক্রয়ে অনীহাসংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের আমলনামা টানা হচ্ছে। একই সঙ্গে ইঞ্জিন ফেউলিউর বন্ধে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইঞ্জিন, লাইন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের বাড়তি সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লে তৎক্ষণাৎ জানাতে বলা হয়েছে স্টেশনমাস্টার এবং পয়েন্টসম্যানদের। তবে ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের বড় অংশের অভিযোগ, ডিভিশন স্তরের কর্মকর্তাদের অধিকাংশই নজরদারির কাজ অধস্তনদের ওপরে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। পরে তেমন খোঁজখবর নেওয়া হয় না।
রেলওয়ে অপারেশন, মেকানিক্যাল ও পরিবহণ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রেলবহরে ১০৬টি মিটারগেজ ডিজেল ইঞ্জিন ক্রয় করা হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ২০২০-২১ সালে ৩০টি ইঞ্জিন কোরিয়া থেকে কেনা হয়। এসব ইঞ্জিন নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ৩০টি ইঞ্জিনের মধ্যে ১১টি ত্রুটিজনিত কারণে প্রায় বন্ধ রয়েছে। বাকিগুলোতেও যততত্র সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ নতুন ইঞ্জিনগুলোও চলন্ত অবস্থায় বিকল হয়ে পড়ছে।
রেলওয়ে রোলিংস্টক দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন কিংবা পুরাতন সব ইঞ্জিনই ফেইলিউর হচ্ছে। ইঞ্জিন ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির শেষ নেই। দুদকেও এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। পাহাড়তলী, সৈয়দপুরসহ রেলে মোট ৫টি ডিজেল ওয়ার্কশপ রয়েছে। এসব ওয়ার্কশপে ৭৬ শতাংশ লোকবল স্বল্পতা রয়েছে। তাছাড়া গত ২৬ বছর ধরে শূন্যপদে একটিও নিয়োগ হয়নি। ওই সময়ের মধ্যে সব দক্ষ শ্রমিক-কর্মকর্তা অবসরে চলে যান। ওয়ার্কশপগুলো যেন শূন্যে ভাসছে। ফেইলিউর ইঞ্জিন মেরামত করার মতো দক্ষ শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না। আবার রোলিংস্টক যন্ত্রাংশের প্রায় ৬৫ শতাংশের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। ইঞ্জিন, যাত্রীবাহী কোচ, পণ্যবাহী ওয়াগন, ডেমু, লাগেজ ভ্যান ও রিলিফ ক্রেনসহ ছয় ধরনের রোলিংস্টক রয়েছে রেলে। মোট রোলিংস্টকের পরিমাণ ৬ হাজার ১৫০টি। এর মধ্যে আয়ুষ্কাল ফুরিয়েছে প্রায় ৪ হাজার রোলিংস্টকের। আবার ১৯টি উদ্ধারকারী ট্রেনের মধ্যে ১৩টির আয়ুষ্কাল শেষ।
ট্রাবল শুটার প্রায় শূন্য : ইঞ্জিন বা কোচ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনবল ট্রাবল শুটার। রেলে বর্তমানে ট্রাবল শুটার পদে অভিজ্ঞ দক্ষ লোকবল প্রায় শূন্য। এ দপ্তরে ৭৬ শতাংশ লোকবল স্বল্পতায় রয়েছে। যাদের টেকনিক্যাল বা প্রযুক্তি জ্ঞান কম, তাদের দিয়ে ইঞ্জিন বা লোকোমোটিভের নিচের অংশ বা আন্ডার-গিয়ার খুঁটিয়ে পরীক্ষ-মেরামত করাও ঝুঁকিপূর্র্ণ। গত ২৬ বছর ধরে এ খাতে কোনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ওই সময়ের মধ্যে দক্ষ শ্রমিক-কর্মকর্তাদের প্রায় ৯০ শতাংশই অবসরে চলে গেছেন। এমন অবস্থায় ইঞ্জিন মেরামতের নামে ফাঁকফোকর আড়াল করার চেষ্টা চলছে কিনা, সেই প্রশ্নও তুলেছেন অবসরে যাওয়া দক্ষ শ্রমিক-কর্মকর্তারা। অভিযোগ, অদক্ষ শ্রমিক দ্বারা ইঞ্জিন মেরামতের নামে বরাদ্দ-অর্থ লুটপাট করা হচ্ছে কিনা, সেই প্রশ্নও তুলছেন কর্তাদের অনেকে।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিংস্টক) আহমেদ মাহবুব চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, রেলের সেফটি ক্যাটাগরির বহু পদ ফাঁকা। অনেক কর্মীকেই কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বিপত্তি এড়াতে গেলে ওই সব পদে দ্রুত কর্মী নিয়োগ দরকার। ইঞ্জিন ফেইলিউর সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে পরিচালনা স্বাভাবিক রাখার সব ধরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন-কোচ না থাকায় আমরা সব রুটে চাহিদা অনুযায়ী ট্রেনও চালাতে পারছি না।
রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী যুগান্তরকে বলেন, যাত্রী সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি পর্যাপ্ত ইঞ্জিন-কোচ দ্রুত প্রয়োজন। প্রতিদিনই ৫-৭টি ইঞ্জিন ফেইলিউর হওয়ার ঘটনা ঘটছে। ওই সব ইঞ্জিন উদ্ধার করতে গিয়ে শিডিউলে নড়চড় হচ্ছে। আমরা আশা করছি লোকবল নিয়োগের সঙ্গে চাহিদা অনুযায়ী রোলিংস্টক ক্রয় করা হলে সমস্যার সমাধান হবে।