ভূমি প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত
মাঠ পর্যায়ে জনবল সংকটে বাধাগ্রস্ত রাজস্ব আহরণ
নন-টেকনিক্যাল ব্যক্তিদের টেকনিক্যাল পদে নিয়োগ
ভূমি প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার (কানুনগো), সার্ভেয়ার, নাজির, উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) এবং জারিকারকসহ বিভিন্ন পদে অর্ধেক জনবলও নেই। মামলা-মোকদ্দমার কারণে সার্ভেয়ার, ড্রাফটসম্যান ও তহশিলদার থেকে কানুনগো পদে পদোন্নতি আটকে আছে।
ফলে মাঠ পর্যায়ে ভূমি রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হচ্ছে। অপরদিকে মাঠ পর্যায়ে তহশিলদারদের প্রতিবেদন কানুনগো এবং সার্ভেয়ার যৌথভাবে যাচাইয়ের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়ার খবরে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। এতে সরকারি সম্পত্তি বেহাত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। এছাড়া ইতোপূর্বে সার্ভেয়ার পদে নন-টেকনিক্যাল নিয়োগ, চেইনম্যান থেকে সার্ভেয়ার পদে প্রশ্নবিদ্ধ পদোন্নতির ঘটনা ঘটেছে। ফলে ভূমি প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে নানাবিধ প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে।
জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম মো. সালেহ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, কানুনগো নেই। এমন জেলাও আছে যেখানে কয়েকটি উপজেলায় মাত্র একজন কানুনগো কাজ করেন।
তিনি আরও বলেন, নিয়োগ বিধির আলোকে পদোন্নতির মাধ্যমে কানুনগো পদগুলো পূরণের সুযোগ থাকলেও কর্মচারীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছে। ফলে বিচরাধীন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার ভূমি মন্ত্রণালয়ের নেই। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) থেকে তাদের কম্বাইন্ড মেরিট লিস্ট চাওয়া হয়েছে। এটা করতে গিয়ে দেখা গেছে আগে যোগদান করা ব্যক্তিরা মেরিট লিস্টে পেছনে চলে যাচ্ছেন। তাই কম্বাইন্ড মেরিট লিস্ট তারা মানতে চান না। সিনিয়র সচিব আরও বলেন, কর্মচারীদের বলেছি মামলা তুলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে।
নন-টেকনিক্যাল ব্যক্তিদের সার্ভেয়ার পদে নিয়োগ ও চেইনম্যানদের সার্ভেয়ার পদে প্রশ্নবিদ্ধ পদোন্নতি প্রসঙ্গে সচিব বলেন, বহু বছর আগে নিয়োগ হয়েছে। পুরাতন নিয়োগ নিয়ে এখন প্রশাসনিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। সরকারি চাকরিতে একবার ঢুকে পড়লে আর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। রাজস্ব আহরণে যাতে কোনো ধরনের বিরূপ প্রভাব না পড়ে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান তিনি।
কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের তহশিলদারদের প্রতিবেদন যাচাইয়ের এখতিয়ার বাতিলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানান ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তবে তাদের এখতিয়ার রহিত করে কোনো ধরনের অফিস আদেশ, পরিপত্র কিংবা বিধিবিধান তৈরি হয়নি।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, ভূমি প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে ম্যানেজমেন্ট ও সেটেলমেন্ট এই দুই ভাগে কানুনগো নিয়োগ হয়। ম্যানেজমেন্ট সাইডে মঞ্জুরিকৃত কানুনগোর পদ ৭৫৪টি। কর্মরত আছেন ৩০০ জন। অর্ধেকের বেশি পদে কোনো জনবল নেই। একই ভাবে ম্যানেজমেন্ট সাইডে সার্ভেয়ারের মঞ্জুরিকৃত পদ ১ হাজার ৩৬টি। বর্তমানে ২৩৮টি পদে কোনো জনবল নেই। সেটেলমেন্ট সাইডে কানুনগোর মঞ্জুরিকৃত পদ ৪০৯টি। কর্মরত আছেন মাত্র ৪৫ জন কানুনগো। সেটেলমেন্ট সাইডে সার্ভেয়ারে অনুমোদিত ২৭২টি। বর্তমানে ১৭০টি পদে কোনো জনবল নেই। অর্থাৎ পদগুলো শূন্য। অন্যান্য সহায়ক জনবল অর্থাৎ নাজির, তহশিলদার এবং জারিকারক পদে গড়ে ৪০ শতাংশ পদে কোনো জনবল নেই বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জনবল শূন্য থাকায় মাঠ পর্যায়ে ভূমি রাজস্ব আদায় মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একজন কর্মকর্তা একাধিক উপজেলায় দায়িত্বপালনের ফলে কোনো কাজই সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া নিয়মিত বিভিন্ন মামলার শুনানিতে অংশ নিতে হয় কানুনগোদের। একজন কর্মকর্তার পক্ষে এত কাজ এককভাবে করা অসম্ভব বলে ভূমি প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানান।
এদিকে কানুনগো এবং সার্ভেয়ারদের তহশিলদারদের প্রতিবেদন যাচাইয়ের দাপ্তরিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া খবরে অনেকে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবে বিষয়টি স্রেফ গুজব বলে উড়িয়ে দিলেন সংশ্লিষ্ট ডেস্ক অফিসার।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের নন ক্যাডার কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮৪, ২০১৪ এবং ২০২১ এই তিনটি বিধিতেই সার্ভেয়ার পদে নিয়োগের জন্য ডিপ্লোমা ইন সার্ভে থাকা বাধ্যতামূলক। পদটি টেকনিক্যাল। অন্য কোনো ডিগ্রি থাকলেও তাতে কাজ হবে না। ডিপ্লোমা ইন সার্ভে থাকতেই হবে। কিন্তু ২০ থেকে ২৫ বছর আগে নিয়োগবিধির শর্ত ভঙ্গ করে কিছু নন-টেকনিক্যাল ব্যক্তিকে সার্ভেয়ার নিয়োগ দেওয়া হয়। সম্প্রতি বিষয়টি ধরে বসেছে পিএসসি। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে সার্ভেয়ার থেকে কানুনগো পদে পদোন্নতির প্রস্তাব পিএসসিতে পাঠালে সংস্থাটি নিয়োগ বিধির আলোকে নিয়োগ হয়েছে কি না তা জানতে চেয়েছে।
পিএসসির প্রশ্নের জবাবে ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে এক সময় বিএ পাশ, বিকম পাশ, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এমনকি এসএসসি পাশ করা ব্যক্তিকে সার্ভেয়ার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যুক্তি দেখানো হয়েছে পর্যাপ্ত সার্ভে ডিপ্লোমাধারী কাউকে না পাওয়ায় ভূমি মন্ত্রণালয় এ ধরনের নন-টেকনিক্যাল ব্যক্তিদের নিয়োগে সায় দিয়েছে।
কিন্তু পিএসপি ভূমি মন্ত্রণালয়ের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শতাধিক নন টেকনিক্যাল ব্যক্তিকে সার্ভেয়ার পদে নিয়োগ দিলেও তাদের ইন সার্ভিসে সার্ভে ডিপ্লোমা পড়ানো হয়নি। ফলে তারা নন-টেকনিক্যালই রয়ে গেছেন। তাদের নিয়োগ অবৈধ, বেতন ভাতাও অবৈধ। তাছাড়া চেইনম্যান থেকেও সার্ভেয়ার পদে পদোন্নতির ঘটনা ঘটেছে, যা বড় অপরাধ। কোনোভাবেই তা করার সুযোগ ছিল না। অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না ভূমি মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মচারীর একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। সব সরকারের সময় এ চক্রটি সক্রিয়। তারা যুগ যুগ ধরে নানা অপরাধ করেই যাচ্ছে। বিষয়টি সরকারের উপদেষ্টাসহ সবাইকে গভীরভাবে অনুসন্ধানের দাবি জানান তারা।