Logo
Logo
×

শেষ পাতা

চলে গেলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক

Icon

মোজাম্মেল হক চঞ্চল

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চলে গেলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক

জাকারিয়া পিন্টু। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক। একজন মুক্তিযোদ্ধা। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়া ফুটবলার। বাংলাদেশের ফুটবলারদের আইকন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (ক্রীড়া)। সর্বোপরি একটি ইতিহাসের নাম। সেই ইতিহাস অস্তমিত হলো। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে ক্রীড়াঙ্গনে। শোক জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার প্রাণপ্রিয় ক্লাব মোহামেডান, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) গভীর শোক প্রকাশ করেছে। ১৯৭১ সালে ভারতের নদীয়ায় প্রথম লাল-সবুজের পতাকা উড়ানো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সেই কান্ডারি জাকারিয়া পিন্টু (৮১) আর নেই। সোমবার বেলা পৌনে ১২টায় ধানমন্ডির শংকরে ইবনে সিনা হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। আগের দিন হার্টের ব্যথায় নিজ বাসায় পড়ে যান। অচেতন অবস্থায় ছেলে তানভীর বাবাকে নিয়ে যান হাসপাতালে। সেখানেই জীবনাবসান হলো এই ফুটবল কিংবদন্তির। গতকাল বিকালে ধানমন্ডির মসজিদে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পিন্টুর সতীর্থ ফুটবলার থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্মের ফুটবলার ও সংগঠকরা। আজ সকাল ১০টায় তার প্রিয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বাদ জোহর জাতীয় প্রেস ক্লাবে তৃতীয় জানাজা ও চিরবিদায় শেষে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হবে।

জাকারিয়া পিন্টু পুরো জীবন ব্যয় করেছেন ফুটবলের জন্য। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে ফুটবল খেলা বিরল ফুটবলারদের একজন ছিলেন এই ডিফেন্ডার। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের আক্রমণ রুখে দিতেন। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে ডায়াবেটিসের সঙ্গে আর কুলিয়ে উঠতে পারেননি। কাল পিন্টুর মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যান ফুটবলার, সংগঠকসহ অন্য খেলার ক্রীড়াবিদরাও।

১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারি নওগাঁ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন জাকারিয়া পিন্টু। তবে বাল্যকালের অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন বরিশালে। মঠবাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। ছিলেন কলেজ ফুটবল দলের অধিনায়ক। ১৯৬০ সালে এইচএসসি পাশ করে তিনি ভর্তি হন বরিশাল বিএম কলেজে। সেখানে থাকতেই অধিনায়ক হিসাবে জয় করেন শেরেবাংলা কাপের শিরোপা। ১৯৬৮ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে এসেও বিশ্ববিদ্যালয় দলের অধিনায়ক হন পিন্টু। তার নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৬০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলেন জাকারিয়া পিন্টু। সেবার করাচিতে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন তিনি। জহিরুল হকের নেতৃত্বে সেবার শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন পিন্টু। ফাইনালে করাচি হোয়াইটসকে ১-০ গোলে হারায় পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দল। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন পিন্টু। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে তার নেতৃত্বেই প্রথম সাফল্য আসে পূর্ব পাকিস্তান দলের। ১৯৭০ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত কিং মহেন্দ্র কাপের শিরোপা জয় করে পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৬৯ সালে জাকারিয়া পিন্টু পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষিক্ত হন। সেবার ইরানের তেহরানে অনুষ্ঠিত জাম-ই দোস্তি কাপে (ফ্রেন্ডশিপ কাপ) খেলে পাকিস্তান। ওই সময় সোভিয়েত ক্লাব স্পার্টাক মস্কো এবং তুর্কি ক্লাব মারসিম তালিক ইয়ুর্দুর বিপক্ষে খেলে পাকিস্তান। একইসঙ্গে ইরাক এবং ইরান জাতীয় দলের বিপক্ষেও ফুটবল খেলেন জাকারিয়া পিন্টুরা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠন ও তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে একঝাঁক স্বাধীনতাকামী ও সাহসী ফুটবলার ও ফুটবল কর্মকর্তা দল গঠন করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ১৬টি ম্যাচ খেলেছিলেন। সেসব ম্যাচ থেকে পাওয়া অর্থ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। জাকারিয়া পিন্টু ছিলেন দলের অধিনায়ক। ২৫ জুলাই ১৯৭১, নদীয়া জেলা একাদশের বিপক্ষে প্রথম আনুষ্ঠানিক ম্যাচ খেলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ম্যাচ শুরুর আগে নদীয়া জেলা প্রশাসক ডিকে ঘোষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে জাকারিয়া পিন্টু বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর গৌরব অর্জন করেন। তিনিই প্রথম গর্বিত বাংলাদেশি, যিনি বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। পতাকা উত্তোলনের সেই ঘটনা নিয়ে পিন্টু বলেছিলেন, ‘ডিসি (ডিকে ঘোষ) আমাদের ম্যানেজমেন্টকে বলেছিলেন যে, অধিনায়ক এবং খেলোয়াড়রা জাতীয় দলের পতাকা ওড়াবেন। কর্মকর্তারা নয়। ২৫ জুলাই আমরা আমাদের দেশের পতাকা প্রায় ৩০ হাজার ভারতবাসীর সামনে উড়িয়েছিলাম। বিদেশের মাটিতে সেটাই ছিল প্রথম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর কোনো ঘটনা। আমরা কলকাতায় ফিরে আসার পর এই ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা হতে শুনলাম এবং পুরো ভারতেই এটা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল। পরে জানলাম, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আমাদের পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দেওয়ায় ডিসি ডিকে ঘোষের চাকরি চলে যায়। তবে পরে অবশ্য তাকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছিল।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরেও জাতীয় দলের হাল ধরেন জাকারিয়া পিন্টু। তার অধীনে ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়া মারদেকা কাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে ফুটবল সংগঠক হিসাবে তিনি জড়িত ছিলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ ফুটবল দল। জাকারিয়া পিন্টু ছিলেন অধিনায়ক। বাংলাদেশ একাদশ ও প্রেসিডেন্ট একাদশের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় ম্যাচটি। ঢাকা স্টেডিয়ামে অবশ্য পিন্টুর দল ০-২ গোলে হেরেছিল প্রেসিডেন্ট একাদশে। ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশ কোচ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন জাকারিয়া পিন্টু। নিজের নামে একটি ফুটবল একাডেমিও প্রতিষ্ঠা করেছেন এই কিংবদন্তি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম