করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ
চলছে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা সমালোচনা
পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে পণ্যবাহী কনটেইনার নিয়ে প্রথম কোনো ফিডার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। কনটেইনার খালাসের পর আবার ইন্দোনেশিয়ার বন্দরের উদ্দেশে ফিরে গেছে সেই জাহাজ। কিন্তু জাহাজ ফিরে গেলেও এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে নানাজন নানা মন্তব্য করছেন। তবে ব্যবসায়ীরা নতুন একটি বন্দরের সঙ্গে সরাসরি পণ্য পরিবহণে যোগাযোগ স্থাপনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। এ নিয়ে সমালোচনাকে তারা ‘রাজনৈতিক’ বলে মন্তব্য করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাকিস্তানের বন্দর থেকে আসা জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে ‘শিথিলতা’ প্রদর্শন তথা শতভাগ কায়িক পরীক্ষার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে কোনো কোনো মহল অভিযোগ তুলে এর রহস্য খুঁজছে। যদিও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, পৃথিবীর যে দেশ থেকেই পণ্য আসুক সবগুলো খালাসের ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য। চট্টগ্রাম বন্দরে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে।
জানা যায়, করাচি বন্দর থেকে গত ১২ নভেম্বর পানামার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি ইউয়ান জিয়াং ফা ঝান ৩৭০টি একক কনটেইনার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এই জাহাজের শিপিং এজেন্ট ছিল সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন কর্ণফুলী শিপিং লাইন্স। পণ্যবাহী ৩৭০টি কনটেইনার খালাসের পর ২৮৯টি খালি ও একটি পণ্যবাহী কনটেইনার লোড করে পুনরায় ওই জাহাজটি ইন্দোনেশিয়ার বন্দরের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করে। বিষয়টি তখনই ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এতে বলা হয়, ‘করাচি থেকে পণ্যবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে, যা ছিল দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ। এ যাত্রা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে তুলে ধরেছে।’
পাকিস্তান হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ তখন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরাসরি শিপিং রুটটির কারণে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। এ অঞ্চলে আরও সমন্বিত ও বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এটি একটি বড় পদক্ষেপ।’ তিনি বলেন, ‘এ উদ্যোগ কেবল বিদ্যমান বাণিজ্যপ্রবাহকে ত্বরান্বিত করবে না, একই সঙ্গে ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় রপ্তানিকারকদের উভয় দিকের ব্যবসার জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে, এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কিছু নেই। আলোচ্য জাহাজটি মূলত দুবাই থেকে যাত্রা করেছে। আসার পথে সেটি করাচি বন্দর থেকেও পণ্য নিয়েছে। আবার ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করেছে। শিপিং এজেন্ট চট্টগ্রাম বন্দরের কাছ থেকে এজন্য অনুমতি নিয়েছে।
এমনিতেই পাকিস্তান থেকে সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আসত। এখন একটি জাহাজ কোম্পানি করাচি বন্দর থেকে পণ্য আনার অনুমতি নিয়েছে। এটিকে নতুন কোনো রুট বলা যাবে না।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক ও ব্যবসায়ী মাহফুজুল হক শাহ যুগান্তরকে বলেন, একমাত্র ইসরাইল ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ নেই। পাকিস্তান থেকে স্পোর্টস সামগ্রী, বৈদ্যুতিক ফ্যান, গার্মেন্ট সামগ্রী, কাঁচামালসহ নানা পণ্য বাংলাদেশে আসে। সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর হয়ে আসত এসব পণ্য। এখন সরাসরি করাচি বন্দর থেকে পণ্য আনার কারণে ফ্রেইট বা জাহাজ ভাড়া কম পড়বে। এতে করে বাংলাদেশের আমদানিকারক ও ভোক্তারা লাভবান হবেন বলে আশা করছি। বিশ্বের সব দেশের পণ্য খালাসের ক্ষেত্রেই চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা একই। রয়েছে অত্যাধুনিক স্ক্যানার। খালাস বা ডেলিভারির আগে তা স্ক্যানারে ধরা পড়ে। সন্দেহজনক পণ্য থাকলে তা কাস্টমস শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে। এটা নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ আছে বলে মনে করি না।
এই ব্যবসায়ী বলেন, ’৮০-র দশকে পাকিস্তান থেকে মাদকজাতীয় পণ্য আসত। সে কারণেই কেউ কেউ হয়তো উদ্বেগের কথা বলছেন। কেউ হয়তো রাজনৈতিক বা ‘ভারতপ্রীতি’র কারণে করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আসার বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছে না। এটা অযৌক্তিক। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সমুদ্রপথে নিয়মিত রুট নিশ্চিত করা গেলে ব্যবসায়িকভাবে উভয় দেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ভিন্ন চ্যানেলে না এনে চাল, পেঁয়াজ, ফলমূলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, এমনকি পোশাকের কাঁচামাল সরাসরি আনা গেলে আর্থিকভাবে লাভবান হবে বাংলাদেশ। আবার পাটসহ অনেক পণ্যের রপ্তানিও ত্বরান্বিত হবে।
যেসব পণ্য এসেছে পাকিস্তান থেকে : পানামার পতাকাবাহী ওই জাহাজে করে করাচি থেকে কী কী পণ্য এসেছে তা কাস্টম ও শিপিং এজেন্ট সূত্রে জানা গেছে। দুবাই থেকে আসার পথে করাচি বন্দর থেকে ২৯৭টি একক কনটেইনার লোড করা হয়। দুবাই থেকে আনা হয় ৭৩টি একক কনটেইনার। সব মিলিয়ে ৩৭০টি কনটেইনার নিয়ে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। করাচি থেকে আসা কনটেইনারে ৩৩৭ টন শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য ছিল। সবচেয়ে বেশি পণ্যের তালিকায় রয়েছে স্যোডা অ্যাশ। ১১৫ কনটেইনার।
৪৬ কনটেইনার খনিজপদার্থ বা ডলোমাইট রয়েছে। ৩৫ কনটেইনারে রয়েছে চুনাপাথর ও ৬ কনটেইনারে রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম কার্বনেট। দেশের কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এসব কাঁচামাল আমদানি করে থাকে।
খালাসের ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রদর্শনের চাপ বা অন্য কোনো সমস্যা হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে জানার জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার ও মুখপাত্রকে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।