হত্যার আলামত ধ্বংস ডিআইজির নির্দেশে!
নেসারুল হক খোকন
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ব্যক্তিগত সম্পর্কের বলি হয়েছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের সান্ত্বনা রায় মিলি চক্রবর্তী (৪৯)। প্রথমে ভিকটিমের বুকে প্রচণ্ড আঘাত করা হয়। এরপর ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সুপরিকল্পিতভাবে হৃৎস্পন্দন থাকাবস্থায় অচেতন দেহ বাইরে এনে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভিকটিমের স্বামী ও ছেলেকে হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড হিসাবে সন্দেহের তালিকায় নিয়েছে পুলিশ। সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে ভিকটিমের দুই ভাই গত ৩ বছর ধরে এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। হত্যাকাণ্ডের সব আলামত গোপনও করে এই পরিবার। রংপুরের তৎকালীন ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনা আত্মহত্যা হিসাবে চালিয়ে দিতে দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন। এই আদেশ মানতে গিয়েই মামলাসহ তদন্তের সব প্রক্রিয়া একরকম বন্ধ করে রাখা হয়। বাড়ির কেয়ারটেকারের জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেওয়ার পর তদন্তের মোড় ঘুরে যায়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালের ৮ জুলাই সান্ত্বনা রায় মিলি চক্রবর্তীকে হত্যা করা হয়। তার স্বামীর নাম সমির কুমার রায়। স্থানীয় পৌর সদরের তাঁতিপাড়ায় তাদের বাড়ি। ঠাকুরগাঁও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলাম সোহাগের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন মিলি। মোবাইলে খুদে বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যমে তারা মিলিত হতেন। বিষয়টি মিলির ছেলে রাহুল রায় ও মেয়ে তিশা রায় জেনে যান। এ নিয়ে ছেলেমেয়ে ও স্বামীর সঙ্গে মিলির সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পরিবারের সদস্যরা বারবার মিলিকে সোহাগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলেন। কিন্তু মুখে সম্পর্ক নেই বললেও মোবাইলে খুদে বার্তায় তাদের যোগাযোগের আলামত পায়। এ নিয়েই মূলত পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি হয়। মেয়ে তিশা বর্তমানে লন্ডনে বসবাস করেন। ছেলে রাহুল বাবা ও মাকে নিয়ে থাকতেন ঠাকুরগাঁওয়ের বাড়িতে।
ঠাকুরগাঁওয়ে কর্মরত সাবেক একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার পারিপার্শ্বিক তথ্য বিশ্লেষণ করে যা জানা যায়, ‘মিলি ও সোহাগের ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে পারিবারিক সদস্যার সৃষ্টি হয় ভিকটিমের পরিবারে। মামলার তদন্তের শুরুতেই ছাত্রদল নেতা সোহাগ ও ছেলে রাহুলকে গ্রেফতার করে তৎকালীন পুলিশ। কিন্তু তৎকালীন ডিআইজির অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে আসামিদের সঠিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদও করা যায়নি। সিআইডি নতুন করে তদন্ত শুরু করলে একজন সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় রংপুর রেঞ্জে কর্মরত ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য তদন্তে হস্তক্ষেপ করেন। মিলি হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা হিসাবে চালিয়ে দেওয়ার কথা বলেন তিনি। যে কারণে ওই সময় দফায় দফায় চেষ্টা করেও সঠিক তদন্ত করা যায়নি। ভিকটিমের এক ভাই রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক। আরেক ভাই সাভারে প্রাইভেট চাকরি করেন। তারা দুজনই পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ করে এ হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তদন্ত শুরু হলেই এরা পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে নানা ধরনের অভিযোগ করেন। এভাবেই কেটে গেছে কয়েক বছর।
জানা যায়, অভিযোগের তির যে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সেই দেবদাস ভট্টাচার্য বিগত সরকারের শেষ সময়ে অতিরিক্ত আইজিপি হিসাবে পদোন্নতিও পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এ চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আড়াল করতে ঠাকুরগাঁওয়ের তৎকালীন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের অযাচিত নির্দেশের পরও ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরা হলেন ঠাকুরগাঁও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলাম সোহাগ ও মিলির ছেলে রাহুল রায়। সম্প্রতি সিআইডি নতুনভাবে তদন্ত শুরু করলে মিলির স্বামী সমির কুমার রায়কে গ্রেফতার করে। সোহাগ ও রাহুল জামিনে আছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর রেঞ্জের ওই সময়ের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলার তদন্তে হস্তক্ষেপ করিনি। সঠিক তদন্ত করতে বলেছিলাম। যেহেতু ঘটনাটি ক্লুহীন ছিল তাই মামলাটি সিআইডিতে পাঠানো হয়। যতদূর মনে পড়ে এই ঘটনায় কেউ মামলাই করতে চাননি। আত্মহত্যার যথেষ্ট আলামত সম্ভবত ছিল। পরে পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করে। কিছুদিন আগে সিআইডির একজন সুপারভিশন কর্মকর্তাকে বলেছিলাম কাউকে যেন অযথা হয়রানি করা না হয়। এখন কেউ যদি আমার বিরুদ্ধে তদন্তে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ করেন তার শাস্তি হওয়া উচিত।’
নথিপত্রে দেখা গেছে, সান্ত্বনা রায় মিলির মরদেহ পাওয়া যায় ঠাকুরগাঁও পৌর সদরের তাঁতিপাড়ার শহিদ মোহাম্মদ আলীর বাটা শোরুমের গলিতে। প্রত্যক্ষদর্শীরা ওই বছরের ৮ জুলাই সকাল ৮টা ২৩ মিনিটে ৯৯৯-এ ফোন করে অজ্ঞাতনামা মহিলার মরদেহ পড়ে থাকার তথ্য দেন। ঘটনা জানাজানি হলে মিলির স্বামী সমির কুমার রায় ও ছেলে রাহুল রায় মিলিকে শনাক্ত করেন। পরে পুলিশ তার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে একটি সাধারণ ডাইরি করে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে পাঠায়। এ বিষয়ে জিডির উদ্ধৃতি দিয়ে ময়নাতদন্তের বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করা হলে বিচারক মামলা করতে নির্দেশ দেন। এরপর হত্যাকাণ্ডের ৩ দিন পর ২০২১ সালের ১০ জুলাই ঠাকুরগাঁও থানার এসআই নির্মল কুমার রায় বাদী হয়ে এ বিষয়ে মামলা দায়ের করেন।
এজাহারে বলা হয়, মিলির শরীরের বিভিন্ন অংশ পোড়া অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে বাদী দিনাজপুর আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য আলামত পাঠানো হয়। মিলির স্বামী ও ছেলে মামলার বাদী নির্মল কুমার রায়কে জানিয়েছেন, ‘২০২১ সালের ৭ জুলাই রাত অনুমান ১০টার দিকে তারা ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন ৮ জুলাই সকাল ৮টার দিকে বাড়ির লোকজন মিলিকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। হত্যার মোটিভ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ঘটনাস্থলে মৃতদেহ ফেলে যাওয়ার কথা বলেন বাদী। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে মিলির আত্মীয়স্বজনকে মামলা দেওয়ার জন্যও বলা হয়। কেউ রাজি না হওয়ায় নিজেই বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন এসআই নির্মল কুমার রায়।
স্বীকারোক্তিতে হত্যার ক্লু : নথিপত্রে দেখা গেছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দিকনির্দেশনা উপেক্ষা করে মিলি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু দেবদাসের তদবিরের কারণে তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। সম্প্রতি মামলাটি ক্লুলেস হিসাবে সিআইডির কাছে ন্যস্ত করা হয়। সিআইডির তদন্তকারী অনুসন্ধানে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। সিআইডি নতুন করে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসাবে ১৬৪ ধারায় স্বীরোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একজন সাক্ষী মিলির বাড়ির কেয়ারটেকার ঠাকুরগাঁওয়ের ইয়াকুবপুরের যোসেফ লাকড়ার ছেলে বিজয় লাকড়া (৩০)। তার জবানবন্দিতেই ঘটনার স্পষ্ট আলামত বেরিয়ে আসে। ২৯ সেপ্টেম্বর বিজয় লাকড়া জবানবন্দিতে বলেন, ‘তিনি ভিকটিম মিলি চক্রবর্তীর বাড়ির ওই সময়ে কেয়ারটেকার ছিলেন। তিনি বাড়ির গ্যারেজে থাকতেন। তৃতীয় তলা বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় থাকতেন তারা। তৃতীয় তলায় একটি প্রাইভেট ক্লিনিক। তার একমাত্র ছেলে রাহুল। মেয়ে বিদেশে থাকেন। ঘটনার দিন ২০২১ সালের ৭ জুলাই রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে মিলির ঘরে কথা কাটাকাটির আওয়াজ শোনেন। ওই রাত প্রায় ১টা-দেড়টার দিকে গ্যারেজে তালা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। অনুমান রাত ৩টা বা সাড়ে ৩টার দিকে মিলির স্বামী সমির রায়ের ডাকে তিনি ঘুম থেকে উঠেন। তখন দেখেন সমির রায়, ভাতিজা মানিক ও ছেলে রাহুল মিলিকে ধরাধরি করে নিচে নিয়ে আসেন। তখন জানতে চাইলে তাকে বলা হয়, তিনি অসুস্থ, সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এক দেড় ঘণ্টা পর তারা বাসায় ফিরে আসেন। পরদিন সকাল অনুমান ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে মিলি রায়ের স্বামী তাকে ডেকে বলেন, ‘আমাদের বাসার গলিতে আগুন লেগেছে।’ সঙ্গে সঙ্গে বাইরে দেখেন ডিশ লাইনে আগুন জ্বলছে। বালি ছিটিয়ে বিজয় আগুন নেভান। আগুন নেভানোর সময় বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের গলিতে একটা লাশ পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। লাশটির শরীরের কাপড় বিভিন্ন স্থানে পোড়া। প্রথমে ধারণা করি কোনো পাগল কারেন্টের শকে মারা গেছেন। কিছুক্ষণ পর জানতে পারি লাশটি মিলির। জবানবন্দির একস্থানে বলেন, ‘যেহেতু রাতে সমির রায়, রাহুল রায় ও মানিক তিনজনে মিলি কাকিকে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে যেতে দেখি তাই আমার ধারণা এ ঘটনার সঙ্গে এই তিনজন জড়িত থাকতে পারেন।’
ময়নাতদন্তে আঘাত : সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘ভিকটিমের প্রাথমিক পোস্টমর্টেম বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষিত ভিসেরার রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বুকে প্রচণ্ড আঘাতের আলামত পায় ফরেনসিক বিভাগ। হৃৎস্পন্দন থাকাবস্থায় মিলিকে অগ্নিদগ্ধ করা হয়। এছাড়া তার মাথার এক অংশে জমাট রক্ত পাওয়া গেছে। দিনাজপুর আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের ডা. মো. হাবিবুর রহমান ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর এ বিষয়ে রিপোর্ট দেন। কিন্তু ডিআইজি দেবদাস স্যারের কারণে তদন্ত বেশি দূর এগোয়নি। এখন এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা শুরু থেকেই রহস্যজনকভাবে অসহযোগিতা করে আসছেন। ভিকটিমের দুই ভাই পুলিশের কাছে জানতে পারেন পরিবারের সদস্যদের কেন গ্রেফতার করা হয়েছিল। কেনই বা তাদের তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। তা না করে তারা মামলাটির পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াই বন্ধ করতে চান।
জানতে চাইলে মিলি চক্রবর্তীর ছোট ভাই শুভেন্দু চক্রবর্তী বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, তার বোন মাঝে-মধ্যে মানসিক ডিপ্রেশনে থাকতেন। যাকে বলা হয় সাইকোটিক পেশেন্ট। চিকিৎসাও করিয়েছেন তাকে। এর আগেও কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। আসলে একটি বিষয় নিয়ে মেয়ের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। ওই দূরত্ব থেকেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে মনে করছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাড়ির কেয়ারটেকার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যে তথ্য দিয়েছে সেটি ভিন্নভাবে বলতে চাই। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গলিতে মরদেহ ফেলে দেওয়ার জন্য পেছনের রাস্তা ব্যবহার না করে কেন সামনের গেট ব্যবহার করা হবে। যে গলিতে অগ্নিদগ্ধ মরদেহ পাওয়া যায় সেখানে পেছনের গেট দিয়েও যাওয়ার সুবিধা আছে। সবকিছুর আমরা চাই সঠিক তদন্ত। নিরপরাধ কাউকে যেন ফাঁসানো না হয়।