বর্ষা ছাড়িয়ে বছরজুড়ে ডেঙ্গুর তাণ্ডব
এডিস দমনে কার্যকর তৎপরতা নেই
তিন কারণে ডেঙ্গু বছরজুড়ে বিস্তার লাভ করেছে -ড. কবিরুল বাশার * সিটি করপোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ব্যর্থতায় ডেঙ্গু বিস্তার লাভ করেছে -ড. জিএম সাইফুর রহমান
আগে শুধু বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যেত, যা প্রধানত ঢাকা ও আশপাশে সীমাবদ্ধ থাকত। কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুতে বছরজুড়ে সারা দেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে রেকর্ড সৃষ্টি করছে। এ বছরও ডেঙ্গুর মৌসুম অন্যান্য বছরের তুলনায় দীর্ঘ হয়েছে এবং বছরের পুরো সময় তা বলবৎ থাকবে বলে আশঙ্কা কীটতত্ত্ববিদ এবং সংশ্লিষ্টদের। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় স্বল্পপরিসরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালালেও ঢাকার পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে মশক নিয়ন্ত্রণের কোনো কাজই হচ্ছে না। এ কারণে ঢাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে কিছু কাজ হলেও তেমন কোনো সুফল মিলছে না। এছাড়া ঢাকায়ও প্রয়োজনের তুলনায় মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম খুবই নগণ্য। ফলে প্রতিনিয়ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সারি দীর্ঘ হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, তিন কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নির্দিষ্ট মৌসুম ছেড়ে বছরজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টির মৌসুম বেড়েছে। এতে লম্বা সময় ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত এডিস মশার প্রজনন উপযোগী পরিবেশ পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এডিস মশার ঘনত্ব বেশি থাকা এবং তৃতীয়ত, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। তিনি জানান, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশার ঘনত্ব কমিয়ে ফেলা বা রোগীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে হবে। সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, তাহলে সফল হওয়া সম্ভব হবে। নইলে তা করা সম্ভব হবে না। তবে আশার কথা হলো-ইতোমধ্যে চলতি মৌসুমে এডিস মশার ঘনত্ব কমতে শুরু করেছে। গত দুদিন রাজধানীর মশার ঘনত্ব বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র মিলেছে। এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বর কীটতত্ত্ববিদ ড. জিএম সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সিটি করপোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণ কাজগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে না। এ কারণে মশার উপদ্রব কমছে না, সিটি করপোরেশনের এ সংক্রান্ত কাজে সত্যিকারার্থে সফলতা মিলছে না। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন যেহেতু মশা নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তাই মশার প্রজনন অনেক বেড়েছে। যেটা বর্ষার মৌসুম শেষেও থাকে। এ কারণে আমরা শীতের মৌসুমেও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হতে দেখছি। যেনতেন কাজে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। ব্রাজিলেও এমন ঘটনা ঘটেছে, মশা নিয়ন্ত্রণে তারাও গুরুত্ব না দেওয়ায় সেখানেও এডিস মশা ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে।
জানা যায়, ডেঙ্গু ভাইরাস চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও বড় দুর্বলতা রয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও একশ প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। যেখান থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের বাস্তব চিত্র আসে না। ডেঙ্গু আক্রান্তের বাস্তব চিত্র বের করে আনতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। নইলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। সরকার এখন যে তথ্য সরবরাহ করছে, বাস্তবে আক্রান্তের হার এর চেয়েও ২০ গুণ বেশি হবে। ২৩ বছর ধরে ধাপে ধাপে সারা দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকার পর্যাপ্ত সময় পেলেও এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এখনো তথ্য সংগ্রহ, তথ্য পর্যালোচনা, ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও ডেঙ্গু প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে বড় গলদ রয়েছে। যে কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করলেও কার্যত কোনো সুফল মিলছে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে নিবন্ধিত হাসপাতাল রয়েছে ৪ হাজার ৯৯৩টি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৯ হাজার ৯৫৬টি। এর বাইরে নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও প্রায় ৩৫ হাজার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বিশাল এসংখ্যক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা পরীক্ষা করাচ্ছেন ও চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একশরও কম হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য সংগ্রহ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য সংগ্রহ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকার সিলেক্টিভ জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। ফলে বাস্তব চিত্র উঠে আসার কোনো সুযোগ নেই। আর বাস্তব চিত্র না পেলে মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো সবসময় ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য লুকানোর চেষ্টা করছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পর্যাপ্ত জনবল, ওষুধ রয়েছে তাদের। তবে নেই কীটতত্ত্ববিদ। কিউলেক্সের মৌসুমে কিউলেক্সের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে তাদের সফলতা থাকলেও বর্ষার ডেঙ্গু তাদের সারা বছর এখন ভোগাচ্ছে। এ তৎপরতা না চালালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। তবে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কাজ না হওয়ায় সেসব এলাকায় অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। যার সিংহভাগ ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছে। সেসব হিসাবও ঢাকার ওপর চাপছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জলাশয় পরিষ্কার, নিয়মিতভাবে মশার ওষুধ ছিটানোর কাজ চলমান রয়েছে। পর্যাপ্ত জনবল, ওষুধসহ সব ধরনের সক্ষমতা রয়েছে তাদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা ধরে তৎপরতাও চালাচ্ছেন তারা। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
কথা হয় রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান, সাধারণত সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পিকে (সর্বোচ্চ চূড়া) পৌঁছায়। অক্টোবরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তবে গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় এ বছর ২৯ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিপাত এবং ২৬ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সঙ্গে এডিস মশার বংশবিস্তার বেশি হয়। এ বছর প্রায় পুরো অক্টোবরেই থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হয়েছে। সবশেষ রোববারও বৃষ্টিপাত হয়েছে। অনেকে মনে করেন, বৃষ্টি কমার সঙ্গে সঙ্গে মশা বাড়ে; কিন্তু না। বৃষ্টিপাতের দেড় মাস পর্যন্ত মশা এবং ভাইরাসের বিস্তার থাকতে পারে। এ কারণে এখনো আক্রান্ত বাড়ছে; সঙ্গে মৃত্যুও। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, এ বছর বৃষ্টির সময় লম্বা হওয়ায় সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কাজের তৎপরতায় তেমন সুফল মিলছে না। আশা করি, বৃষ্টির প্রকোপ শিগ্গিরই কমে যাবে। তখন পরিস্থিতি অনেকাংশে উন্নতি হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নেওয়া হচ্ছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সেসব থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে সামছুল কবির যুগান্তরকে বলেন, এ বছরের মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। এখনো মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে; এটা এডিস মশার প্রজনন উপযোগী পরিবেশ। এ অবস্থার উন্নতি না হলেও সিটি করপোরেশনের তৎপরতায় তেমন সুফল মিলছে না।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের জনবল, ওষুধ এবং অন্যান্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা রয়েছে। সেসব সক্ষমতার শতভাগ প্রয়োগ করে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের সক্ষমতার আলোকে সব ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।