মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থ বিভাগের সিদ্ধান্ত
নিত্যপণ্য আমদানিতে একক ব্যক্তি ঋণসীমা থাকছে না
শূন্য মার্জিনে খোলা যাবে এলসি * টিসিবির কার্ডধারীরা ৫ কেজির পরিবর্তে ১০ কেজি চাল পাবেন * রোজা পর্যন্ত সুবিধাগুলো কার্যকর
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিগ্গিরই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং চালের মূল্য কমছে না-এমন তথ্য দিয়ে অতিপ্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন থাকছে না বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। বড় কোম্পানিগুলোর একক ঋণসীমা তুলে নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। দুটি সিদ্ধান্তই সাময়িক যা আসন্ন রোজা পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। আর মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় নিম্ন-আয়ের মানুষকে টিসিবির মাধ্যমে এখন থেকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে, যা আগে ছিল ৫ কেজি।
বুধবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে এ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়, যা পরে ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে অবহিত করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য বা কথা বলেননি অর্থ উপদেষ্টা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান, অর্থসচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানরা অংশ নেন।
বৈঠকের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সাংবাদিকদের বলেন, পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন আগেই তুলে দেওয়া হয়। এখন মার্জিন ছাড়াই অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলা যাবে। আগামী রোজা পর্যন্ত যেন কোনো ব্যাংক মার্জিন চার্জ না করে, সেটি রোববার থেকে কার্যকর হবে।
তিনি বলেন, বড় ব্যবসায়ীদের নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে একক ঋণসীমা তুলে নেওয়া হবে। যদিও একক ঋণসীমা অতিক্রম করা কোনোভাবে উচিত নয়। এজন্য ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে হতে পারে। তবে ব্যাংক সংস্কারের মাধ্যমে মূলধন বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে একক ঋণসীমা যাতে অতিক্রম না করে, এ ব্যাপারে কঠোর হব।
মূল্যস্ফীতির পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে উল্লেখ করে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘প্রথম কারণ হচ্ছে সাম্প্রতিক বন্যা। যে কারণে পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এছাড়া অন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। এর প্রতিফলন বাজারে আসতে বাধ্য। যদিও এটি খারাপ কিছু নয়। আর শেষটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতির সূচক এখন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না, সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে। তাই সঠিক মূল্যস্ফীতির হার একটু বেশিই হবে।’
গভর্নর বলেন, এ সময়ে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কম, গ্যাসসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কমছে, যা আমাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। এতে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি হবে না, কমতে বাধ্য। এখন অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক করা হয়েছে। তবে এ সংকোচন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি না কম, সেটি খতিয়ে দেখা হবে। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে মুদ্রানীতি সংকোচন করার পরও ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লেগেছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আনতে। ফলে আমাদের সে পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে। মূল্যস্ফীতি শিগ্গিরই কমবে না। গত মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, এটি ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ইউকে, ইএসএ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সর্বত্র মুদ্রানীতি সংকোচন করার ফলে মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে নেমে আসছে।
চালের মূল্য প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, দেশের প্রেক্ষাপটে এর মূল্য বেশি আছে। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। তবে গত বছর এ সময় কেজিতে ৫-৬ টাকা আরও বেশি ছিল। অর্থাৎ গত বছর এক কেজি মোটা চালের দাম ৬৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। শূন্য শুল্ক করার পরও কেউ আমদানি করছে না। ভারত থেকে আনতে গেলেও ট্রাক ভাড়া দিয়ে বর্তমান বাজারমূল্য থেকেও ব্যয় বেশি হবে। ফলে চালের ডিউটি জিরো এবং আমদানিও জিরো। এর অর্থ-বাজারে এ পণ্যের সরবরাহ খারাপ নয়, ঘাটতি নেই। এছাড়া কৃষকের কথাও ভাবতে হবে, যদিও আমরা চালের মূল্য কমাতে চাচ্ছি। কৃষকের ব্যয়, মজুরি-এসব মিলে বাদ দিয়ে কিছু পয়সা থাকবে। তবে চালের দাম ভবিষ্যতে কমবে, সেটিও আশা করা ঠিক হবে না।
নিত্যপণ্যের মূল্য প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ৫-৬টি কোম্পানি চিনি, গম, ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের সঙ্গে নিয়ে বাজার মনিটরিং করা হবে। এসব কোম্পানির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সিন্ডিকেশন হয়। কারণ, তারা বিদেশ থেকে বড় বাল্কে পণ্য আনে, যা ছোট আমদানিকারকের পক্ষে মূল্য ও পণ্য নিয়ে আসার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। কারণ, দেখা গেছে একটি কোম্পানি ৩২টি জাহাজের মালিক। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ভাড়া নিজেরাই সমন্বয় করে নিচ্ছেন। তারা যে দামে পণ্য কিনতে পারবে, ছোটরা পারবে না। এগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এছাড়া অযৌক্তি নয়, পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে বা রেড দিয়ে বাজার মনিটরিং করব না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেটি কমিয়ে আনা হবে। অযৌক্তিক মনিটরিং দাম কমাবে না।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রোজার আগে কিছু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ধরে রাখতে হবে। সঠিক আছে কি না, সেটি দেখতে কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্যও পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকার কী উদ্যোগ নিচ্ছে-এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, কয়েকটি পণ্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বাজার মনিটরিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।