টোল ফ্রির নির্দেশনা মানছে না সরকার
রোগীর কাঁধে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার বাড়তি চাপ
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, টানেল ও এক্সপ্রেসওয়েতে রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স থেকে টোল (পথশুল্ক) না নিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকার গণপরিবহনের মতো অ্যাম্বুলেন্স থেকে টোল তথা পথশুল্ক নিতে পারবে না। ফলে রোগী পরিবহণে ভাড়া কম নেওয়ার কথা। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স মালিক-চালকদের দাবি হাইকোর্টের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। গণপরিবহণের মতো তাদেরও পথশুল্ক দিতে হচ্ছে। এ কারণে ভাড়ার অঙ্ক কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে রোগীর কাঁধে বাড়তি ভাড়ার চাপ চিকিৎসাসেবায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। রাজধানীর একাধিক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে রোগী, স্বজন, অ্যাম্বুলেন্স মালিক, চালক-সহকারীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, এর আগে এক আইনজীবী সারা দেশের সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, টানেল, ফেরি ও এক্সপ্রেসওয়েতে অ্যাম্বুলেন্স থেকে টোল না নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আবেদন করেন। সেই আবেদনে সাড়া না পাওয়ায় হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। চলতি বছরের ১২ আগস্ট বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, টানেল, ফেরি ও এক্সপ্রেসওয়েতে অ্যাম্বুলেন্স থেকে টোল না নেওয়ার আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মো. মনির উদ্দিন।
অ্যাম্বুলেন্স সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন হাইকোর্টের নির্দেশনার পরও রাজধানীর মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে ৯০ টাকা করে টোল নেওয়া হয়। পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ে পারাপারের সময় রোগী থাকলে টোল নেওয়া হয় না। কিন্তু খালি অ্যাম্বুলেন্স, ডেডবডি থাকলে এবং লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানের টোল নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে পদ্মা সেতুতে ১৩৫০, উত্তরবঙ্গগামী যমুনা সেতুতে ৬০০, এক্সপ্রেসওয়ের মাওয়া টোল পয়েন্টে ১৩০ এবং শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকার পয়েন্টে ৮৫ টাকা নেওয়া হয়। এ ছাড়া রাজধানীর এয়ারপোর্ট থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে রোগীবিহীন অ্যাম্বুলেন্সে ৮০ টাকা করে নেওয়া হয়। একইভাবে ঢাকার বাইরে কুমিল্লার দাউদকান্দি মেঘনা-গোমতী সেতুতে রোগীসহ ও রোগী ছাড়া ৯০ টাকা নেওয়া হয়। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি পারাপারে ৮০০ টাকা নেওয়া হলেও বর্তমানে ১২৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। লালমানিরহাটের তিস্তা ব্রিজেও টোল দিতে হয়।
রোববার আগারগাঁওয়ের জাতীয় অর্থোপেডিকস ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনে কয়েকজন রোগীর স্বজন ভাড়া নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালক-সহকারীদের সঙ্গে দর কষাকষি করছিলেন। আমিনুল ইসলাম নামে একজন জানান, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পর ভাইকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। চিকিৎসা শেষে সিরাজগঞ্জ ফিরতে চান। অ্যাম্বুলেন্স চালক ৬ হাজার টাকার ভাড়া ৮ হাজার দাবি করছেন। শেষে বলছেন সাড়ে ৭ হাজারের কমে যাবেন না।
উত্তরবঙ্গ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের চালক আসলাম হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ৮৯ টাকা লিটার অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বেড়ে ১৩৫ হয়েছে। পথে খরচ হবে সাড়ে তিন হাজার, চালক হেলপারের ভাড়া ছাড়াও মালিককে দিতে হয়।
ঢাকা মেডিকেলের সামনে কয়েকজন চালক বলেন, অ্যাম্বুলেন্স সাধারণত ডিজেল, অকটেন ও সিএনজি গ্যাসে চলে। বছরখানেক আগে প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪ ও অকটেনে ৪৬ টাকা করে বেড়েছে। এক লিটার অকটেন ৮ কিলোমিটার ও ৫০০ টাকার সিএনজি গ্যাসে ৯০ কিলোমিটার চলে। আগে পাঁচ লিটার মবিলের দাম ১৮০০ টাকা ছিল। বর্তমানে ২৫০০ করে বিক্রি হচ্ছে। কিছু দিন আগেও একজোড়া চাকার দাম ছিল ২৩ হাজার টাকা। এখন ২৬ হাজার টাকা হয়েছে। চাকা মেরামত, এয়ার, মবিল, এসি, অক্সিজেন ফিল্টারসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ মাসে ২০ হাজার টাকা খরচ যায়। এর বাইরে মালিককে চালক-সহকারীর থাকা খাওয়া, মাসিক বেতন ও ওভারটাইমের খরচ দিতে হয়।
আরেক চালক বলেন, পঞ্চগড় থেকে ঢাকার দূরুত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। আইসিইউ লাইফ সাপোর্ট সংবলিত একটি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যেতে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়। সাধারণ অ্যাম্বুলেন্স ১৫ হাজার, লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স রোগীর সঙ্গে স্বজন, চিকিৎসক, প্যারেমেডিক ও ব্রাদার আসনসহ সব ধরনের সুবিধা থাকে। এজন্য ঢাকা থেকে রংপুর দিনাজপুর ট্রিপে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা নেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে নরমাল (সাধারণ), আইসিইউ লাইফ সাপোর্ট সংবলিত ও লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানসহ তিন ধরনের অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। নরমালে সিএনজি গ্যাস ও অকেটেন, আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে শুধু অকটেন, ফ্রিজার ভ্যানের অর্ধেক ডিজেল এবং অর্ধেক অকটেনে চলে। অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস খসড়া নীতিমালা-২০২৩ অনুযায়ী কোম্পানির মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত অ্যাম্বুলেন্সে মহানগরীর মধ্যে প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা উল্লেখ আছে। মহানগরীর বাইরে প্রথম দুই কিলোমিটারে ভাড়া সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। পরে প্রতি কিলোমিটার ৬০ টাকা। ভাড়ায় চালিত অ্যাম্বুলেন্সে মিটার সংযোজন করতে হবে। মিটারে ভাড়ার সময় এবং মোট ব্যবহারের সময় রেকর্ড থাকতে হবে। কেউই এ নিয়ম মানছে না।
ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, হাইাকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও হাতেগোনা কিছু জায়গা ছাড়া সবখানে টোল দিতে হয়। পথে ছোটখাটো ব্রিজ, বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদাসহ অনেক সময় পুলিশকে খুশি করতে হয়। অনেক সার্জেন্ট মামলার পরিবর্তে তিন হাজার টাকা নেন। এজন্য অ্যাম্বুলেন্স টোল ফ্রি করা, বিএআরটিএ আট সিট অনুমোদন এবং অকটেন, সিএনজি গ্যাসের দাম কমানো জরুরি। অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, মালিক সমিতি ভাড়া বাড়ায়নি। কিছু চালক-হেলপারদের বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, সারা দেশে বিএরআটিএর নিবন্ধনভুক্ত ৮ হাজারের মতো অ্যাম্বুলেন্স আছে। এর মধ্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে আছে প্রায় ২ হাজার। ঢাকা মহনগরীতে আছে আড়াই হাজারের মতো। তিনি বলেন, হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিলেও প্রায় সবখানে টোল নেয়। তবে কোর্টের কাগজপত্র ও রোগীর সঙ্গে হাসপাতালের রিপোর্ট থাকলে কিছু জায়গা টোল নেয় না। তিনি বলেন, এর আগে অ্যাম্বুলেন্স মালিকরা ধর্মঘটে যান। ওই সময় বিআরটিএ, ঢাকা মেট্রোপলিট্রন (ট্রাফিক), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস নীতিমালা-২০২৩ খসড়া তৈরি হলেও গেজেট হয়নি। খসড়ায় নির্ধারিত ভাড়ায় রোগী পরিবহণ নিশ্চিতের কথা বলা আছে। মাঝে রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিআরটিএ চেয়ারম্যানসহ দপ্তরগুলোর অনেক কর্মকর্তা বদলি এবং ওএসডি হয়েছেন। বর্তমানে ৯৫ শতাংশ অ্যাম্বুলেন্সে কাগজপত্র নবায়ন নেই। আমরা চাই দ্রুত নীতিমালা হোক। উন্নত বিশ্বের একটি অ্যাম্বুলেন্সে যত ধরনের সুবিধা থাকে সরকার নীতিমালা পাশ করলে সমিতি সার্বিক সহায়তা করবে।