Logo
Logo
×

শেষ পাতা

৫৪ বছরে ১৭ খুন, শতাধিক মামলা, সহস্রাধিক আহত

ভৈরবে চিরবিবদমান দুই বংশের সংঘর্ষে নিহত ১

বিরোধের নেপথ্যে দুই চেয়ারম্যান * নিঃস্ব গ্রামবাসী

Icon

ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভৈরবে চিরবিবদমান দুই বংশের সংঘর্ষে নিহত ১

কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার মৌটুপি গ্রামে চিরবিবদমান দুই বংশের মানুষের মধ্যে শুক্রবার সংঘর্ষে একজন প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত কাইয়ূম মিয়া (৪৫) সরকার বংশের লোক। সংঘর্ষে এদিন আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের মৌটুপি গ্রামটি স্থানীয়দের কাছে একটি ‘দাঙ্গাবাজ গ্রাম’ হিসাবে পরিচিত। সাত হাজার মানুষের এই গ্রামে রয়েছে ‘কর্তা বংশ’ ও ‘সরকার বংশ’ নামে দুটি বড় বংশ। গত ৫৪ বছর যাবত গ্রামের আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতার জেরে দুই বংশের ১৭ জন খুন হয়েছেন। কমপক্ষে শতবার সংঘর্ষ, বাড়িঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। বারবার মারামারি-সংঘর্ষে হাজারের বেশি আহত হয়েছেন।

সাদেকপুর ইউনিয়নে দুই বংশের নেতারাই বারবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমান চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মো. সাফায়েত উল্লাহ সরকার বংশের লোক। এর আগে তার বাবা আবুবকর সিদ্দিক তিনবার ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। অন্যদিকে সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা তোফাজ্জল হক কর্তা বংশের লোক। দুই বংশের দুই চেয়ারম্যান এখন তাদের নিজ নিজ বংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

কয়েক দিন আগেও সরকার বংশের ইকবাল মিয়া (২৯) নামের একজন খুন হন। গত ঈদুল আজহার পরদিন কর্তা বংশের নাদিম মিয়া (৫৫) খুন হন। এর আগে ২০০৫ সালে সরকার বাড়ির সাফায়েত চেয়ারম্যানের আপন দুই ভাই ওবাইদুল্লাহ ও হেদায়েত উল্লাহ কর্তা বংশের লোকজনের হাতে খুন হন। বহু বছর আগে আরও একাধিক ব্যক্তি ঝগড়া-সংঘর্ষে খুন হয়েছেন। এসব খুন সংঘর্ষের ঘটনায় এখনো অর্ধশত মামলা আদালতে চলমান আছে। আসামির সংখ্যা দুই বংশের কয়েকশ হবে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো-দুজন বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যান কেউ এলাকায় থাকেন না। তাদের বাড়িঘর থাকলেও তারা ভৈরব শহরের বাসায় বাস করে এলাকায় ঝগড়া বিবাদ লাগিয়ে রাখেন। একাধিক খুনের মামলার আসামি এই দুই চেয়ারম্যান। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারে না। পুলিশের ভাষায় তারা পলাতক। মৌটুপি গ্রামে পুলিশ মামলার আসামি গ্রেফতার করতে যায় না। যদি কখনো যায় তবে কমপক্ষে অর্ধশত পুলিশকে দল বেঁধে যেতে হয়। নতুবা পুলিশই ঝুঁকিতে পড়ে যায়। তাই ঝগড়া, সংঘর্ষ হলে ভয়ে পুলিশ সহজে এই গ্রামে যেতে চায় না। স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক নেতারা বহুবার চেষ্টা করেও দুই বংশের বিরোধ মীমাংসা করতে পারেননি। বিশেষ করে দুই চেয়ারম্যান মীমাংসায় সম্মতি দেন না। তারা ‘মামলাবাজ’ হিসাবে পরিচিত। কারণ মামলা করলে দুই চেয়ারম্যানের টাকার বাণিজ্য জমে ওঠে। কোনো পক্ষ কোনো ঘটনায় মামলা করলে আসামি করার ভয় দেখিয়ে লোকজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করেন তারা। আবার চার্জশিট থেকে নাম কেটে দেবে বলেও টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তবে তারা দুজনই এভাবে অর্থ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।

মৌটুপি গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা অন্য বংশের লোক হয়েও বাঁচতে পারি না। কোনো না কোনো বংশকে সমর্থন করতে হয়। গত ৫৪ বছরে এই গ্রামে কমপক্ষে দেড় ডজন খুন হয়েছে, আহত হয়েছে হাজারো মানুষ। মামলা হয়েছে কয়েকশ। এসব বিরোধের মূল হোতা দুই চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ ও তোফাজ্জল হক। একই গ্রামের বৃদ্ধ হাফিজ মিয়া বলেন, দুজন চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করলেই মৌটুপি গ্রাম নীরব হয়ে যাবে। কয়েক মাস আগে কর্তাবাড়ির নাদিম খুন হলে সরকার বাড়ির অন্তত ২০০ বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পালিয়ে যায় সরকার বাড়ির কয়েকশ পরিবার। পরে সরকার বংশের ইকবাল খুন হলে কর্তা বংশের শতাধিক বাড়িঘর লুটপাট হয়। শুক্রবার তারা বাড়ি এলে আবারও সংঘর্ষে কাইয়ূম খুন হলেন।

এ বিষয়ে সরকার বংশের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. সাফায়েত উল্লাহ বলেন, কর্তা বাড়ির বিএনপি নেতা তোফাজ্জল হক এই বিরোধ লাগিয়ে রেখেছে। তারা আমার দুই ভাইকে হত্যা করেছে। শুক্রবারের সংঘর্ষের নায়ক সে, আমি নই। গ্রামের যে কোনো মীমাংসায় আমি রাজি কিন্তু তোফাজ্জল মীমাংসায় রাজি নয়। গ্রামের দাঙ্গার জন্য সে দায়ী।

অন্যদিকে কর্তা বংশের বিএনপি নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হক বলেন, ৫৪ বছর আগে সাফায়েতের বাবা আমার বংশের কফিল উদ্দিনকে গলা কেটে হত্যা করে। ক’দিন আগে খুন করল আমার ভাই নাদিমকে। আরও খুন করেছে কয়েকজনকে। আমি গ্রামে থাকি না, থাকি ভৈরব শহরে। অথচ একাধিক ঘটনায় সাফায়েত উল্লাহ আমাকে আসামি করেছে। কিভাবে মীমাংসা করব।

ভৈরব থানার ওসি মোহাম্মদ হাসমত উল্লাহ বলেন, আমি থানায় যোগদান করেছি দুই মাস হলো। এরই মধ্যে দুটি খুন হলো মৌটুপি গ্রামে। ৫৪ বছর যাবত গ্রামের দুই বংশের বিরোধ চলছে জানলাম। স্থানীয় জনগণ এই গ্রামকে দাঙ্গাবাজ গ্রাম বলে ডাকে। তবে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আমি চেষ্টা করছি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম