ছায়া মেয়র হয়ে চালাতেন স্বামীকে
লুকিয়ে থেকেও বরিশালে কোন্দলে উসকানি লুনার
আত্মগোপনে থাকা সদ্য সাবেক মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতের স্ত্রী লুনা আব্দুল্লাহর দুটি ফেসবুক পোস্ট নিয়ে বরিশালে এখন তোলপাড় চলছে। সোমবার ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেওয়া দুটি পোস্টে লুনা বরিশালের ওয়ার্ড এবং কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দুটি পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা দিয়েছেন। এ তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাহস নিয়ে রাজপথে নামারও আহবান জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের পতনের প্রায় আড়াই মাস পর লুনার দেওয়া এই পোস্টের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে নিরীহ ছাত্রলীগ কর্মীদের বিপদে ফেলা হচ্ছে বলে বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা মন্তব্য করেছেন। প্রভাবশালী সেরনিয়াবাত পরিবারে বিরাজমান অন্তর্দ্বন্দ্ব আর বিরোধকেই লুনা আবারও সামনে নিয়ে এসেছেন বলেও কেউ কেউ দাবি করছেন। সরকার পতনের আগ পর্যন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে বরিশাল শাসন করতেন সাবেক মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত। তিনি স্ত্রী লুনার কথায় চলতেন-এটাই প্রতিষ্ঠিত বরিশালে। খোকনের অবৈধ সব আয়ই জমা হতো লুনার কাছে, এমন আলোচনাও ছিল।
গত বছর জুনে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে হঠাৎ করেই নৌকার মনোনয়ন পান শেখ মুজিবের ভাগ্নে খোকন সেরনিয়াবাত। এর আগে বরিশালের জনগণ তাকে সেভাবে চিনত না। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মকাণ্ডেও তিনি ছিলেন না। এই মনোনয়নের মাধ্যমে সবাই জানতে পারে যে, খোকন বরিশালের আরেক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছোট ভাই। দুই ভাইয়ের পরিবারে চরম বিরোধের বিষয়টিও তখন প্রকাশ পায়। নির্বাচনে হাসানাতপুত্র সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহও চান দলীয় মনোনয়ন। ছেলের জন্য মনোনয়ন বোর্ডে তদবির করেন হাসানাত আব্দুল্লাহ। তবে শেষ পর্যন্ত খোকন মনোনয়ন পাওয়ায় দুই পরিবারের বিরোধ আরও জটিল আকার ধারণ করে। একপর্যায়ে ভাতিজা সাদিক আব্দুল্লাহকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার মিশনে নামেন খোকন। মেয়র হয়ে নিজের তৈরি করা বলয় নিয়ে আলাদাভাবে শুরু করেন রাজনৈতিক কর্মসূচি। রাজনীতির সব সেক্টর থেকে সাদিক অনুসারীদের উৎখাতের চেষ্টাও করেন তিনি।
সরকার পতনের আগের রাতে পরিবারসহ বরিশাল থেকে পালিয়ে যান খোকন। সাদিক পালান ৫ আগস্ট দুপুরে। নগরের কালীবাড়ি রোডে থাকা বাসায় হামলা-অগ্নিসংযোগের আগে পর্যন্ত স্ত্রী সন্তানসহ তিনি সেখানেই ছিলেন। এর আগে আগস্টের প্রথমদিকে ছেলে আশিক আব্দুল্লাহকে নিয়ে দেশ ছাড়েন হাসানাত। তবে দেশে থাকা হাসানাতের আরেক ছেলে সেরনিয়াবাত মঈন আব্দুল্লাহ গত সপ্তাহে গ্রেফতার হন রাজধানীর গুলশান থেকে। আগস্ট বিপ্লবে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের একটি মামলায় তিনি বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন।
সেরনিয়াবাত পরিবারের প্রভাবশালীদের খোঁজ না মিললেও সোমবার নিজের ফেসবুক পেজে দুটি পোস্ট দিয়ে আলোচনায় আসেন খোকনপত্নী লুনা আব্দুল্লাহ। বরিশাল বিএম কলেজ এবং নগরীর ৫নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির দুটি তালিকা দিয়ে তিনি তাদের রাজপথে নামার আহ্বানও জানান। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় তীব্র প্রতিক্রিয়ার।
এমডি রাজু ইসলাম নামে একজন লিখেছেন, ‘কাজটা ভালো করলেন না। এমনিতেই এরা (তালিকায় থাকা ছাত্রলীগ নেতারা) বিপদে আছে। তার ওপর সবার নাম-পরিচয় প্রকাশ করে আরও বিপদে ফেললেন।’ খান মাহাদী হাসান নামে লিখেন, ‘মাথায় ফুঁ দিয়ে মামলার আসামি করার সুযোগ করে দিলেন।’ আরিফ সোহাগ লিখেছেন, ‘ভালো পাইলেন নাকি বাঁশ দিলেন?’ রেজিন উল কবির লিখেন, ‘পুলিশে নাম পাইয়া গেল। এইটা করে পোলাপানগুলারে বিপদের মুখে ফেলা হইলো।’ প্রিন্স মাহমুদ লেখেন, ‘এটা তো অমানুষের পরিচয় দিছে।’ আরাফাত ইসলাম লেখেন, ‘লিস্ট সামনে আগাইয়া দিছে, যাতে এদের বিরুদ্ধে মামলা করতে সুবিধা হয়।’ এ কথায় দুটি পোস্টের একটিতেও কেউ ইতিবাচক মন্তব্য লেখেনি।
পরিচয় না প্রকাশের শর্তে বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, ‘২০২২ সালে কমিটিগুলোর অনুমোদন দেয় তখনকার সাদিক অনুসারী মহানগর ছাত্রলীগ। তখন এসব কমিটির বিরোধিতা করে খোকন অনুসারীরা। ব্যাকডেটে কমিটি করে ছাত্রলীগ দখলের পাঁয়তারা চলছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন লুনা আব্দুল্লাহ। নিজস্ব লোকজন দিয়ে মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি আনার জন্য কেন্দ্রে চালান তদবির। অথচ আজ সাদিক অনুসারীদের সেসব কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করছেন ফেসবুক পেজে।’
অজ্ঞাত স্থান থেকে দেওয়া বক্তব্যে মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক রইজ আহম্মেদ মান্না বলেন, ‘৮০-৮৫ সদস্যের ওই কমিটির অনেককে চেনে না বিএনপি বা পুলিশ প্রশাসনের সদস্য। সোমবার পর্যন্ত এদের অনেকে বরিশালেই ছিল। এই পোস্টের পর তারা যেমন নিরাপত্তাহীন হলো তেমনি পালাতেও হয়েছে।’ মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল বলেন, ‘ব্যবসায়িক কারণে ভারতে আসার সময় ভুল বোঝাবুঝির কারণে গত ৮ আগস্ট কিছু সময়ের জন্য আমাকে আটক করে বিজিবি। পরে অবশ্য ছেড়েও দেয়। এই নিয়ে ২-১টি অনলাইনে সংবাদ প্রকাশ হলে নিজের ফেসবুক পেইজে শেয়ার দেন লুনা। ৬ আগস্ট যখন আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর জন্য কঠিন বিপদ, তখন তিনি তার ফেসবুকে শেয়ার দেন সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর একটি ভিডিও। যেখানে শোনা যায় তিনি বিএনপি নেতাদের সমালোচনা করছেন। বিষয়টি এমন যেন সাদিক আব্দুল্লাহকে যে কোনো উপায়ে ধ্বংস করার চেষ্টা।’
মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উড়ে এসে জুড়ে বসা একজন খোকন সেরনিয়াবাত। তাকে আবার চালাতেন স্ত্রী লুনা। কেবল ক্ষমতার লোভে পারিবারিক পরিচয় ব্যবহার করে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে মেয়র হয়েছিলেন। আজ যদি তার রাজনৈতিক জ্ঞান থাকত তাহলে তিনি বা লুনা বুঝতেন যে দলের কতটা দুঃসময় চলছে। এখনো তারা পারিবারিক দ্বন্দ্ব নিয়ে আছেন। এটা দুঃখজনক।’
লুনা আব্দুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। খোকন পরিবারের ঘনিষ্ঠ মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাড. আফজালুল করিম বলেন, ‘বিষয়টি আমার কাছেও ভালো লাগেনি। তাদের (খোকন ও লুনা) তো আর পাচ্ছি না তবে লুনার ভাইকে বলেছি। এ ধরনের কর্মকাণ্ড যেন সে আর না করে। এখন আর আমাদের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। সবাই এক হয়ে দুঃসময় অতিক্রমের চেষ্টা করছি। লুনা যেটা করেছে সেটা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক।’