Logo
Logo
×

শেষ পাতা

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ

কেনাকাটায় পশ্চিমাঞ্চল রেলে ব্যাপক দুর্নীতি

আনু মোস্তফা

আনু মোস্তফা

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কেনাকাটায় পশ্চিমাঞ্চল রেলে ব্যাপক দুর্নীতি

পশ্চিমাঞ্চল রেলে গেল কয়েক বছরে কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। সম্প্রতি এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে পশ্চিম রেলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মামুনুল ইসলাম বলেন, অডিট রিপোর্টে আপত্তি এলেই যে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে, তা ঠিক নয়। এগুলোর বেশির ভাগই সমাধানযোগ্য। এজন্য আমরা অডিট টিমের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সভার আয়োজন করছি। সভায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিরীক্ষা দলকে জবাব দেবেন। গ্রহণযোগ্য জবাব দিতে না পারলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক গত অর্থবছরে মেসার্স এইচআর এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে ২০ মেট্রিক টন হার্ড কোক কেনেন। ঠিকাদারকে টনপ্রতি পরিশোধ করা হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার টাকা। যদিও বাজারে টনপ্রতি হার্ড কোকের দাম মাত্র ৩৭ হাজার ১২০ টাকা। ২০ টন হার্ড কোক নিতে ঠিকাদারকে পরিশোধ করা হয়েছে ২৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যা বাজারমূল্যের চেয়ে ১৪ লাখ ২০ হাজার ৬৪০ টাকা বেশি।

পশ্চিমের সিসিএম দপ্তরে ছয়টি কেন্ট রিপ্লেসমেন্ট কিটের প্রতিটি কেনা হয়েছে ৩ হাজার ৫৭০ টাকায়। এ পণ্যের বাজারমূল্য ১ হাজার ২০০ টাকা। বাজারমূল্যের সঙ্গে ঠিকাদারের মুনাফাসহ আনুষঙ্গিক আরও ৪০ শতাংশ যোগ করলে প্রতিটির দাম পড়ে ১ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু ছয়টি কিটেই ঠিকাদারকে অতিরিক্ত ১১ হাজার ৩৪০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। একইভাবে ১ হাজার ২৮৮ টাকার মেমব্র্যান কেনা হয়েছে ২ হাজার ৮৬০ টাকায়। আর লালমনিরহাটের বিভাগীয় ট্রাফিক সুপার কার্যালয়ে ৮৫ হাজার ৪০০ টাকার ফটোকপি মেশিন কেনা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৮০ টাকায়। এছাড়া বাজারে যে টোনার মাত্র ৭০০ টাকায় পাওয়া যায়, তা কেনা হয়েছে ৫ হাজার ১৯০ টাকায়। ৫০টি টোনার কিনতেই লুট হয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার ৫০০ টাকা।

অন্যদিকে পাকশীর বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার দপ্তরে তিনটি প্রোজেক্টর কেনা হয়েছে, প্রতিটি ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা করে। যদিও বাজারে এর দাম ৫৫ হাজার টাকা। ঠিকাদারের লাভ, ভ্যাট, আয়কর বাবদ ৪০ শতাংশ অতিরিক্ত হিসাব করলে এর দাম পড়ে ৭৭ হাজার টাকা। ফলে তিনটি প্রোজেক্টরেই অতিরিক্ত ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এ দপ্তরে ৩৪ হাজার ৫৮০ টাকার আলমারি ৩৯ হাজার ৫০০ টাকায়, ২১ হাজার ৬১৩ টাকার ফাইল কেবিনেট ২৫ হাজার ৫০০ টাকায়, ৯১ হাজার টাকার এসি ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকায়, ২৮ হাজার টাকার স্ক্যানার মেশিন ৩৭ হাজার টাকায় এবং ২৯ হাজার ৪০০ টাকার কালার প্রিন্টার ৪৭ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে।

পশ্চিমাঞ্চলের সিএসটিই দপ্তরেও কেনাকাটায় ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে। ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দামের ফটোকপি মেশিন ঠিকাদার দিয়ে কেনা হয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকায়। ৪১ হাজার ৫০০ টাকার মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের বাজার দাম ৫৮ হাজার ১০০ টাকা। এটি ঠিকাদারের কাছ থেকে কেনা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮০০ টাকায়।

এদিকে পাকশীর ডিএসটিই অফিসে ৯০টি সিসি ক্যামেরা কেনায় ঠিকাদারকে অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে ১২ লাখ ৭১ হাজার ৬০ টাকা। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৬০টি স্টারলাইট আইপি বেইজড সিসি ক্যামেরা সরবরাহ করেছে মেসার্স এমএম টেকনোলজি। ৪০টি সিসি ক্যামেরার প্রতিটির দাম দেওয়া হয়েছে ১৯ হাজার টাকা করে। আবার একই সিসি ক্যামেরার ৩০টির প্রতিটি কিনতে এমএম টেকনোলজিকে দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার টাকা। বাজারে এসব ক্যামেরার সর্বোচ্চ দাম ৪ হাজার ৫৫০ টাকা। এদিকে একই দপ্তরে ২০টি ৫ মেগাপিক্সেল আইপি বেইজড সিসি ক্যামেরা প্রতিটি কেনা হয়েছে ২২ হাজার ৭৯০ টাকা করে। বাজারে এসব ক্যামেরার দাম ৩ হাজার ৫৩০ টাকা।

অন্যদিকে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক দুটি টেলিভিশন কিনতে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৮০ টাকা, একটি মাইক্রোওভেনের জন্য ৩৯ হাজার ৯৯০ টাকা, একটি ইলেকট্রিক চুলার জন্য ৪ হাজার ৯৯০ টাকা এবং একটি আইপিএসের জন্য ১ লাখ ৪৯ হাজার ৯০০ টাকা বিল পরিশোধ করেছেন। প্রতিবেদন বলছে, এসব মালামাল না কিনেই পুরো টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। রাজশাহীর উপসহকারী প্রকৌশলীর দপ্তর ১৮ ওয়াটের ইলেকট্রনিক ব্যালাস্ট কেনা দেখিয়েছে ৪৪ হাজার ১০০ টাকায়। কিন্তু নিরীক্ষা টিম দেখেছে এগুলো আদৌ কেনাই হয়নি। পাঁচটি টায়ার-টিউব কেনার ভুয়া বিলের পাকশীর তৎকালীন বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা তুলে নিয়েছেন ১ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকা।

এদিকে ক্রয় দেখানো হলেও পশ্চিমের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তার দপ্তরে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৪১০ টাকার পাঁচটি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ট্রলি, বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক কারখানায় ৯৫ হাজার ৮২ টাকার লিড অ্যাসিড ব্যাটারি, সৈয়দপুর জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে ৫ লাখ ৩ হাজার ২৪৯ টাকার অয়েল কেরোসিন ও পেইন্ট অয়েল পেস্ট ফিল্টার, লালমনিরহাটের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৫৩ টাকার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, লালমনিরহাটের বিভাগীয় ট্রাফিক সুপারের কার্যালয়ে ২ লাখ ৫ হাজার ৭৯৪ টাকার ১০৩টি বিছানার চাদর এবং পাকশী বিভাগীয় পরিবহণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে ৫৯ হাজার ৯৯৬ টাকার চারটি চেয়ার না কিনেই বিল তুলে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।

এদিকে সৈয়দপুর ডিসিওএস ১ লাখ ৯৯ হাজার ৯৮০ টাকায় ৪টি সেলফ স্টার্টার কেনে। চুক্তিপত্রে বলা ছিল, জার্মানির তৈরি স্টার্টার দেবে ঠিকাদার। কিন্তু দেওয়া হয়েছে চায়নার। পার্বতীপুরের ডিজেল শপে ৭৫ ভোল্টের ১৫০টি বাল্ব কেনা হয় ৯২ হাজার ২৫০ টাকায়। চুক্তিপত্রে চায়নার বাল্ব সরবরাহ করার কথা থাকলেও ঠিকাদার দিয়েছে ভারতের। সৈয়দপুর ডিসিওএস ১ কোটি ১ লাখ ৮৩ হাজার ৯৬০ টাকার অ্যাঙ্গেল কক ও এসএস শিটও কিনেছে নিম্নমানের। চুক্তিপত্রে ভারত ও চায়নার মালামাল দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। এসব মালামালের গায়ে উৎপাদনকারী দেশ ও ব্র্যান্ডের নাম ছিল না। একইভাবে পশ্চিম রেলের বিভাগীয় বৈদ্যুতিক প্রকৌশলীর দপ্তর ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪০ টাকার নিম্নমানের কেবল ও ফ্রিওন গ্যাস কিনেছে। চুক্তিপত্রে বিআরবি কেবল কেনার কথা বলা হলেও ঠিকাদার দিয়েছে এসকিউ ব্র্যান্ডের। আবার আমেরিকার তৈরি ফ্রিওন গ্যাসের কথা বলা হলেও দিয়েছে চায়নার।

প্রতিবেদন বলছে, চাহিদা নেই, তবু পণ্য না কিনেই বিলের টাকা লুট করা হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে চাহিদা না থাকলেও ১ কোটি ২৮ লাখ ৯০ হাজার ৩৩৬ টাকার অতিরিক্ত মালামাল কেনা দেখানো হয়েছে। এসব পণ্য আদৌ কেনা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেনি নিরীক্ষা টিম।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম