বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার
আইন-চুক্তি-কৌশলপত্র বাস্তবায়নে জোর
অর্থ পাচারের পুরোনো মামলা তদন্ত হবে * মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালায় যুক্ত হচ্ছে দুদক * উদ্ধার কার্যক্রমে গতি আনতে নেওয়া হচ্ছে সমন্বিত উদ্যোগ
সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া বাংলাদেশের অর্থ ফেরত আনতে সাতটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে রয়েছে মানি লন্ডারিং মামলা তদন্তে দুদককে অন্তর্ভুক্তকরণ, সরকারের কৌশলপত্র বাস্তবায়ন, ব্যাংকের সন্দেহজনক লেনদেন বিশ্লেষণ, সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে এমএলএ চুক্তি এবং পাচারের তথ্য চেয়ে পাঠানো চিঠির জবাব পেতে সমন্বয় কার্যক্রম গ্রহণ। এছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো, অর্থ পাচারসংক্রান্ত পুরোনো মামলার তদন্ত এবং পাচার প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কার্যক্রমে সমন্বিত উদ্যোগ।
দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাচারের অর্থ ফেরত আনতে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠক করেন ২ বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালে। এরপর আর কোনো বৈঠক হয়নি। আবার ওই বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা হয়নি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ভেতরে বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে চলমান বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশের টাকা পাচারের বিষয়টি। ওয়াশিংটনে বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, পাচারের অর্থ ফিরিয়ে নিতে বিভিন্ন দেশে বেসরকারি খাতের আন্তর্জাতিকমানের এজেন্সি নিয়োগ দেওয়া হবে। আইনগত দিক থেকে পাচার হওয়া টাকার ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আইনি ফার্ম কাজ করবে। এ লক্ষ্যে আইনগত ও কারিগরি সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে।
এর আগে পাচারের অর্থ ফেরাতে অর্থ উপদেষ্টা সম্প্রতি বৈঠক করেন জাতীয় সমন্বয় কমিটির সঙ্গে। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, পররাষ্ট্র সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, অর্থ ও বাণিজ্য সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে মানি লন্ডারিং মামলার তদন্তে দুদককে সম্পৃক্ততার বিষয়টি। বর্তমানে মানি লন্ডারিংসংক্রান্ত মামলার আওতায় ‘দলিল দস্তাবেজ জালকরণ, প্রতারণা, জালিয়াতি, দেশি ও বিদেশি মুদ্রা পাচার, চোরাচালান ও শুল্কসংক্রান্ত অপরাধ, করসংক্রান্ত অপরাধ এবং পুঁজিবাজার সংক্রান্ত অপরাধ, ইনসাইডার ট্রেডিং অ্যান্ড মার্কেট ম্যানিপুলেশনসংক্রান্ত অনসন্ধান ও তদন্ত করতে পারে না দুদক। বৈঠকে বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করে দুদকের সচিব বলেন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ২ (ঠ) ধারা সংশোধন করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা ২০১৯ এর তফশিলে অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি দুদককে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। এ প্রস্তাবের পক্ষে আরও যুক্তি তুলে পরবর্তী বৈঠকে বিস্তারিত তুলে ধরার জন্য দুদককে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সর্বশেষ তথ্যমতে, নভেম্বরের দ্বিতীয় বৈঠকে এ প্রস্তাব তুলে ধরার জন্য দুদক সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক অর্থিক খাতের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতিবছর ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এসব টাকা যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ডে।
অর্থ পাচারসংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, উল্লিখিত ১০টি দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স (এমএলএ) টায়ার বা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে এমএলএ খসড়া চুক্তিপত্র পাঠানো হয়েছে। এসব চুক্তি সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং মানি লন্ডারিং অপরাধের সুষ্ঠু তদন্তের জন্য এমএলএ খসড়া অনুরোধের জবাব পেতে কার্যকর সমন্বয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের সাবেক উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে এ চুক্তি হওয়া জরুরি। তাহলে পাচারকৃত অর্থ ফেরত ও পাচারের মামলাগুলোর তদন্তে বেশ অগ্রগতি হবে।
এদিকে সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে আগের সরকার একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে ছিল। ওই কৌশলপত্রে বলা হয়, যে দেশগুলোতে অর্থ পাচার হয়েছে, সেই দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে তদন্ত করে অর্থ ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া সম্পদ জব্দ করতে আদালতের আদেশ পেতে দেরি হলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে লেটার অব রেগুলেটরি পাঠিয়ে ওই দেশের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাচারকারীর অর্থ বা সম্পদ অন্য দেশে স্থানান্তর প্রক্রিয়া আটকে দেবে সরকার। লেটার অব রেগুলেটরি হলো, বিচারিক সহায়তার জন্য এক দেশের আদালত থেকে অপর একটি দেশের আদালতের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ। কিন্তু এই কৌশলপত্র প্রণয়ন হলেও বাস্তবায়ন করেনি আগের সরকার। এটি পর্যালোচনা করে অর্থ উপদেষ্টা পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে কৌশলপত্র বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে বিদেশে পাচার করা সম্পদ জব্দ করে দেশে ফেরত আনতে সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার অংশ হিসাবে দেশের ছয়টি সংস্থা কাজ করছে। এরমধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন, বিএফআইইউ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিরেক্টরেট (সিআইআইডি) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এসব সংস্থাকে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারসংক্রান্ত কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অর্থ পাচারের অভিযোগে অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হলেও স্বাধীনতার পর পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার নজির আছে মাত্র দুটি। এর একটি হলো, সিঙ্গাপুর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকা ফেরত আনা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফিলিপাইনে পাচার হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ফেরত এসেছে ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার এবং শ্রীলংকা থেকে এসেছে ২০ মিলিয়ন ডলার। এজন্য বর্তমানের পাশাপাশি পাচারসংক্রান্ত আগের মামলাগুলোর তদন্ত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই বৈঠকে।
এদিকে বিদেশে অর্থ পাচার রোধে ব্যাংক খাতে ‘নগদ অস্বাভাবিক লেনদেন (সিটিআর) ও সন্দেজনক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) কঠোর নজরদারিতে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশনার পর বিভিন্ন ব্যাংকে এ ধরনের লেনদেন গভীরভাবে বিশ্লেষণ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। পাশাপাশি মানি লন্ডারিং যেন না হয় সেজন্য গ্রাহকের লেনদেন মনিটরিং জোরদার করতে সব তফশিলি ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে সিটিআর এবং এসটিআর লেনেদেন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই আট মাসে ব্যাংক খাতে ২ কোটি ৫৬ লাখ ৯৬ হাজার ২২২টি ব্যাংকে (সিটিআর) লেনদেন শনাক্ত করা হয়। এরমধ্য থেকে বিশ্লেষণ করে ১০ হাজার ৮১৬টি সন্দেহজনক (এসটিআর) লেনদেন শনাক্ত করা হয়। সন্দেহজনক গ্রাহকের হিসাবগুলোর মধ্যে ১৭৬টি ঘটনাকে অধিক তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছে বিএফআইইউ। তবে বর্তমান হিসাবে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।