ঢাকা চেম্বারের গবেষণা
হাতবদলে চালের দাম ৩ গুণ
যৌক্তিক মুনাফা করার আহ্বান এফবিসিসিআই প্রশাসকের
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কৃষকের কাছ থেকে ভোক্তার পাতে ওঠার পর্যন্ত হাত বদলের (উৎপাদন, পাইকারি, খুচরা পর্যায়) কারণে শুধু সরু চালের দাম বৃদ্ধি পায় ৩০৭ শতাংশ। একই অবস্থা স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত সব ধরনের নিত্যপণ্য যেমন মোটা চাল, পেঁয়াজ, আদা-রসুন, রুই মাছ, ডাল, আলু, কাঁচামরিচ, হলুদ ও শুকনা মরিচের দামের ক্ষেত্রে। অপেক্ষাকৃত কম দাম বাড়ে আমদানিনির্ভর পণ্য যেমন সয়াবিন তেল, গম, চিনি ও গুঁড়া দুধের।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে সম্প্রতি গবেষণা পরিচালনা করে সংগঠনটি। বৃহস্পতিবার সেই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ২০ থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ৮টি বিভাগের ৪৯টি জেলায় যেখানে ৬০০ জন উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় ২১টি খাদ্যপণ্যের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ১২টি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত, ৫টি আমদানিকৃত এবং বাকি ৪টি স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানি করা হয়।
গবেষণার তথ্যমতে, এক কেজি ভালোমানের মোটা চাল উৎপাদনে কৃষক পর্যায়ে সর্বোচ্চ খরচ পড়ে ২৬ টাকা। সেই চাল কৃষক বিক্রি করে ৩২ টাকায়। ভোক্তাদের সেই মোটা চাল কিনতে হয় ৬০ টাকায়। অর্থাৎ শুধু হাত বদলে মোটা চালের দাম ২১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায় বা ২৮ টাকা। একইভাবে প্রতি কেজি সরু চালের দাম পার্থক্য প্রায় ৪০ টাকা, পেঁয়াজের ৪০ টাকা, রুই মাছের ১২০ টাকা, ডালে ৩০ টাকা, আলু ২৯ টাকা, কাঁচামরিচ ৭২ টাকা এবং হলুদে ১০০ টাকা।
গবেষণার তথ্যমতে, পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন, জোগান এবং আমদানির সমন্বয়হীনতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা, তথ্যের অসামঞ্জস্যতা, স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদন হ্রাস, সার, বীজ, তেল ও কীটনাশকের উচ্চ মূল্য এবং জেলাভিত্তিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমও এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। মূল্যস্ফীতি রোধে পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পণ্য সংরক্ষণ বাড়াতে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় স্টোরেজ সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করে সংগঠনটি।
ডিসিসিআই মনে করে, পণ্য উৎপাদন খরচের ক্রমাগত উচ্চ মূল্য, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা, পণ্য পরিবহণের উচ্চ হার, বাজার আধিপত্য এবং উৎপাদনকারীদের খুচরা বাজারে প্রবেশাধিকার স্বল্প সুযোগের কারণে স্থানীয় বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যের ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও কৃত্রিম সংকট, ঋণপত্র খোলায় প্রতিবন্ধকতা, টাকার মূল্যমান হ্রাস, সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থায় অদক্ষতাও পণ্যমূল্য উঠানামায় ভূমিকা রাখছে। উৎপাদন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির চাপ পড়ায় উৎপাদক পর্যায়ে মোটা চাল, সরু চাল, পেঁয়াজ, রুই মাছ, আলু, মসুর ডাল, কাঁচামরিচ, হলুদ, লাল মরিচ, আদা ও রসুনের মতো বেশিরভাগ পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ভোক্তাপর্যায়ে দাম বাড়লেও উৎপাদকরা ন্যায্য দাম পান না। কখনো কখনো দাম বাড়ানোর জন্য পরোক্ষ খরচ জড়িত হয়। সংরক্ষণ, পরিবহণ এবং পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যায়ে খরচ কমাতে পারলে নিত্যপণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে কমে আসতে পারে। তিনি আরও বলেন, সংরক্ষণের অভাবে পচনশীল পণ্যের বড় একটি অংশ অপচয় হয়। প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন এই বিশাল ক্ষতি রোধে ভালো সমাধান হতে পারে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা চেম্বারের নির্বাহী সচিব (গবেষণা) একেএম আসাদুজ্জান পাটোয়ারী। তিনি বলেন, বর্তমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ হলো প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। এছাড়াও অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা এবং তথ্যের অসামঞ্জস্যতা, স্থানীয় উৎপাদন হ্রাস এবং উচ্চ পরিবহণ খরচ, কীটনাশকসহ সার-বীজ-তেলের উচ্চ মূল্য ভূমিকা রাখছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা করার মত দেন তিনি।
সেমিনারে নির্ধারিত আলোচনায় অংশ নেন-বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. সায়েরা ইউনুস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্রেড সাপোর্ট মেজারস উইংয়ের যুগ্ম-সচিব ড. সাইফ উদ্দিন আহম্মদ, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের যুগ্ম প্রধান মশিউল আলম এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপ-পরিচালক (সেনসাস উইং) স্বজন হায়দার প্রমুখ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. সায়েরা ইউনুস বলেন, শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে পণ্যের মূল্য কমানো সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৯ বার পলিসি রেট পরিবর্তন করলেও বাজারে এর প্রভাব তেমন উল্লেখজনক নয়। এজন্য সরকারকে প্রান্তিক পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে আমদানির বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। কারণ কোভিড পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সাপ্লাই চেইন মারাÍকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় পণ্য উৎপাদন ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্রেড সাপোর্ট মেজারস উইংয়ের যুগ্ম-সচিব ড. সাইফ উদ্দিন আহম্মদ বলেন, প্রতিবছর আবাদি জমি ১ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদন ক্রমাগত হারে কমে যাচ্ছে। এর কারণে আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। বতর্মানে কৃষি খাতে ভর্তুকি ৪-৫ শতাংশ, এটিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় ১০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হলে, স্থানীয় উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
যৌক্তিক মুনাফার আহ্বান এফবিসিসিআইর : নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক মুনাফা করার আহ্বান জানিয়েছেন এফবিসিসিআইর প্রশাসক হাফিজুর রহমান। বৃহস্পতিবার মতিঝিলে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে ডিম, ব্রয়লার মুরগি, পেঁয়াজ, আলুসহ নিত্যপণ্যের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এই আহ্বান জানান তিনি।
এফবিসিসিআইর প্রশাসক বলেন, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিত্যপণ্যের কিছুটা মূল্যবৃদ্ধি হয়। তবে বর্তমানে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভোক্তাদের অস্বস্তিতে ফেলেছে। সরবরাহ ব্যবস্থায় কয়েক ধাপে পণ্য হাত বদলের কথা শুনছি। অনাবশ্যক হাতবদল কমিয়ে কিভাবে যৌক্তিক মূল্যে পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে ব্যবসায়ী সস্প্রদায়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।