Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ছিলেন সিনেমার টিকিট মাস্টার

বগুড়ার আ.লীগ নেতা এখন কোটিপতি

Icon

বগুড়া ব্যুরো

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বগুড়ার আ.লীগ নেতা এখন কোটিপতি

নন্দীগ্রামের বাঁধন সিনেমা হলের টিকিট মাস্টার আনোয়ার হোসেন রানা (৪৫) এক সময়ে স্থানীয় একটি দৈনিকে মাত্র দেড় হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন। সেই রানাই বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে কয়েক বছরে বনে গেছেন কোটিপতি। ব্যবহার করেন কয়েকটি বিলাসবহুল গাড়ি। নামে-বেনামে তার রয়েছে বিপুল সম্পদ-সম্পত্তি। দলীয় প্রভাবে নন্দীগ্রাম উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্রের মুখে শাশুড়ির শতকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। স্ত্রীসহ ওই মামলায় তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তবে, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কয়েকটি মামলা হওয়ায় তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আনোয়ার হোসেন রানা বগুড়ার ধুনট উপজেলার যমুনা নদীর চর বৈশাখী গ্রামের শামসুল হকের ছেলে। গ্রামের বাড়ি নদীতে বিলীন হলে পরিবারের সদস্যরা নন্দীগ্রামে বসতি স্থাপন করেন। রানা নন্দীগ্রামের বাঁধন সিনেমা হলের টিকিট মাস্টারের চাকরি করতেন। এরপর তিনি ১৯৯৭ সালে বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলা পত্রিকার নন্দীগ্রাম উপজেলা প্রতিনিধি হন। দুর্নীতির দায়ে নন্দীগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পদক পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। ২০০৩ সালে বগুড়া শহরের নবাববাড়ি সড়কে শেখ সরিফ উদ্দিন সুপার মার্কেটের মালিক দেলওয়ারা বেগমের বড় জামাতা ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম দুর্জয় বাংলার মালিকানা কিনে নেন। পরের বছর ২০০৪ সালে রানা পত্রিকার প্রধান কার্যালয় বগুড়া শহরে চলে আসেন। সেখানে তিনি অবৈতনিক স্টাফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পত্রিকার অন্যান্য কাজও করতেন। একপর্যায়ে তার বেতন ধরা হয় দেড় হাজার টাকা। ২০০৬ সালে সাইফুল ইসলামের আকস্মিক মৃত্যু হয়। এ মৃত্যু নিয়ে তখনই নানা গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। এরপর রানা সাইফুল ইসলামের বিধবা স্ত্রী আকিলা সরিফা ও দুই ছেলের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। পত্রিকা অফিসে কাজের পাশাপাশি তিনি পরিবারের নানা কাজও করতে থাকেন। ২০০৯ সালে স্ত্রী-সন্তান থাকার পরও রানা আকিলা সরিফার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তাকে বিয়ে করেন। এরপর থেকে স্বল্প বেতনের কর্মচারী রানার জীবনে উত্থান শুরু হয়।

এরপর রানা তার কোটিপতি শাশুড়ি দেলওয়ারা বেগমের সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। চার শ্যালিকা ও তাদের স্বামী-সন্তানদের দমিয়ে রাখতে ২০০৯ সালে রানা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লেখান। জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত আলহাজ মমতাজ উদ্দিনের নিকটজন হতে তার কাছের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। মমতাজ উদ্দিনের আস্থাভাজন হয়ে তিনি নন্দীগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও পরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের পদ লাভ করেন। রানা ২০১৫ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরিফ বিড়ি ফ্যাক্টরির মালিক দেলওয়ারা বেগমকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি দেলওয়ারা-সেখ সরিফ উদ্দিন সুপার মার্কেট দখলে নেন। শাশুড়ি দেলওয়ারা বেগমের মৃত্যুর ৬ দিনের মাথায় ২০২৩ সালের ১০ মে তিনি শহরতলির শাকপালা এলাকার সরিফ সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন দখল করেন।

দেলওয়ারা বেগমের জামাতা ব্যবসায়ী মোফাজ্জল হোসেন রঞ্জু অভিযোগ করেন, রানা মার্কেট দখলে নিয়ে নাম করেন, ‘সরিফা ট্রেড সেন্টার’। এরপর থেকে রানা ওই মার্কেটের দোকান ভাড়া, মার্কেটের ডিজাইন পরিবর্তন, পজিশন বিক্রি ও অগ্রিম ভাড়া আদায় শুরু করেন। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। তিনি আত্মগোপনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ৪ বছরে ওই মার্কেট থেকে অন্তত ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। নন্দীগ্রামের কলেজপাড়াসহ আশপাশে নামে-বেনামে প্রচুর জমি ও অত্যাধুনিক বাড়ি করেছেন। চারটি আধুনিক গাড়ি ব্যবহার করেন। শাজাহানপুরের শাকপালায় বেনামে এসআর প্রিন্টিং প্রেস এবং শরিফা প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন নামে ছাপাখানা গড়েছেন। সেখানে কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ছাপাখানায় বৈধভাবে ব্যান্ডরোল ছাপিয়ে সরিফ বিড়িতে ব্যবহার করে সরকারকে কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত করেছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা রয়েছে বা লেনদেন হয়েছে।

সুচতুর রানা ২০১৯ সালে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের মৃত্যুর পর রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এমএম কামাল উদ্দিনের ভক্ত হন। একপর্যায়ে নন্দীগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ হাতিয়ে নেন। ক্ষমতা ও অবৈধ অর্থ কামাইয়ের সুবিধার্থে দ্বিতীয় স্ত্রী আকিলা সরিফাকে রাজনীতিতে আনেন। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও জেলা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পিংকি সরকারকে ম্যানেজ করে টাকার বিনিময়ে কোষাধ্যক্ষ পদ লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিলেও রাজনীতি করেননি। রানা রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ় করতে মুক্ত জমিন, আমার সোনার দেশ ও সাপ্তাহিক তাজা খবর নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। বর্তমানে পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা বন্ধ রয়েছে। তবে সাপ্তাহিক তাজা খবর এখনো প্রকাশিত হচ্ছে একজন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের মাধ্যমে।

তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাসদের জেলা সভাপতি রেজাউল করিম তানসেনকে প্রার্থী করায় তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পরে নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টি করে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।

দেলওয়ারা-সেখ সরিফ উদ্দিন সুপার মার্কেট ও সরিফ সিএনজি লিমিটেড কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবা সরিফা খানম আমেনা জানান, রানার বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা আত্মসাৎ মামলা করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলেও বিচার কার্যক্রম শুরু হয়নি। তিনি দাবি করেন, অর্থের বিনিময়ে রানা বিচার থামিয়ে দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠান দুটির নির্বাহী পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন রঞ্জু জানান, তারা মার্কেট ও সিএনজি স্টেশনের মালিকানা ফিরে পেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পলাতক রানার ক্যাডাররা বাধা দিয়েছে। সাবেক জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে গিয়ে লাভ হয়নি। তারা নতুন ডিসি ও এসপির কাছে অভিযোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট ক্ষমতা রদবদলের পর রানার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা ও অন্যান্য মামলা হয়েছে। রানা এর আগে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে লাইসেন্স দিয়ে শটগান কিনেছেন। ওই লাইসেন্স বাতিলের জন্য প্রায় ৪ বছর আগে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে আবেদন করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে লাইসেন্স বাতিল হয়নি। আত্মসাতের বিষয়ে রানার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলার প্রস্তুতি চলছে।

আনোয়ার হোসেন রানা মোবাইল ফোন বন্ধ ও হোয়াটসঅ্যাপে সাড়া না দেওয়ায় অভিযোগগুলোর ব্যাপারে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার খোঁজে দেলওয়ারা-সেখ সরিফ উদ্দিন সুপার মার্কেটে গেলে কর্মচারীরা জানান, স্যার মামলাসংক্রান্ত ঝামেলায় আছেন। শিগগিরই তিনি ফিরে আসবেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম