খালেদা জিয়ার কার্যালয় অবরুদ্ধের কারিগর
সততার সাইনবোর্ডে রাজকীয় জীবন ‘ওসি রফিক’র
স্ত্রী-সন্তান বসবাস করেন অস্ট্রেলিয়ায়
তোহুর আহমদ
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
রফিকুল ইসলাম। গুলশান থানার সাবেক দাপুটে ওসি। ১১ বছর আগে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিশেষ বাধা দেওয়ার ঘটনায় আলোচনায় আসে রফিকের নাম। এ সময় অভিনব কৌশলে বালু বোঝাই ট্রাক রেখে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় আটকে দেওয়া হয়। অবরুদ্ধ করা হয় বিএনপির চেয়ারপারসনকে। এতে দলটির পূর্বনির্ধারিত মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি পুরোপুরি ভণ্ডুল হয়ে যায়। এ ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে।
তবে ঘটনার পর রফিকের কপাল খুলে যায়। পরপর দুদফা পদোন্নতি পান তিনি। ইন্সপেক্টর থেকে বনে যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। আওয়ামী লীগের পুরো সময়ে তিনি ছিলেন গুলশান এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এমনকি ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগের দিন পর্যন্ত তিনি গুলশানেই কর্মরত ছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই রফিককে গুলশান থেকে সরিয়ে ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওসি রফিকের বাড়ি মেহেরপুর। কিন্তু নিজেকে তিনি গোপালগঞ্জের বাসিন্দা বলে পরিচয় দিতেন। এমনকি তার পরিবারের সদস্যদের অনেকে আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা এমন কথা বলতেন সগৌরবে। এছাড়া নিজেকে সৎ দাবি করে মহত্ত্বের নানা উদাহরণ টানতেন। হরহামেশা বলতেন গুলশান থানার ওসি হয়েও ঘুস নেন না। সৎ ওসি হিসাবে তিনি পুলিশ বাহিনীর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। অথচ বাস্তব চিত্র ঠিক এর উলটো। সুকৌশলে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান রফিক। রাজকীয় জীবনযাপনের কাছে দুর্নীতির রাঘববোয়ালদের অনেকে হার মানে।
অভিজাত বাড়ি : রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই ব্লকের এক নম্বর রোডে ঢুকতেই সুরম্য ভবনটি সবার নজর কাড়ে। প্লট নম্বর ৫৬৬/৫৬৭। চার কাঠা জায়গার ওপর ৯ তলা সুরম্য ইমারত। আধুনিক স্থাপত্য নকশায় তৈরি ভবনটি সিঙ্গেল ইউনিটের। একেকটি সুপরিসর ফ্ল্যাটের আয়তন দুহাজার বর্গফুটের বেশি। রফিক বসবাস করেন ৫ম তলায়। ভবনের অন্য ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মালিক রফিক।
সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের প্রবেশমুখে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সার্বক্ষণিক দায়িত্বে রয়েছেন দুজন পোশাকধারী নিরাপত্তা প্রহরী। বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে ভবনের পার্কিংয়ে চারটি প্রাইভেট কার দেখা যায়। এর একটিতে (ঢাকা মেট্রো গ-৩৫-১৫৮৯) লেখা ‘পুলিশ’। বাকি গাড়িগুলো পর্দায় ঢাকা। নিচতলার একদিকে সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন কয়েকজন গাড়িচালক।
ভবনে ঢোকার সময় এগিয়ে আসেন রফিকের গাড়িচালক বাদল। ভাড়াটিয়া পরিচয় দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বাদল বলেন, বর্তমানে কোনো ফ্ল্যাট খালি নেই। সর্বশেষ একটি ফ্ল্যাট খালি ছিল। সেটিও গত মাসে ভাড়া হয়ে গেছে। এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া প্রতি মাসে ৫৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জ হিসাবে অতিরিক্ত আরও ৭ হাজার টাকা দিতে হয়। বাড়ি মালিকের নাম জানতে চাইলে সন্দেহের চোখে তাকান বাদল। এক পর্যায়ে বলেন, ‘মালিক গুলশানের ওসি (বর্তমানে এডিসি) রফিক স্যার। আরও কিছু জানার থাকলে গুলশান থানায় যান। তার সঙ্গে কথা বলেন।
বিদেশে স্ত্রী-সন্তান : রফিকের দুই সন্তান দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। সেখানে তারা ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন। এছাড়া রফিকের স্ত্রী আনজুমানারা বেগমও সন্তানদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। রফিক নিজেও অস্ট্রেলিয়া যাতায়াতের ওপর থাকেন। প্রতি বছর একাধিকবার তিনি ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, রফিক নিজেই গর্ব করে বলেন, বিদেশে সন্তানদের কাউকে তিনি চাকরি করতে দেন না। তাদের লেখাপড়ার খরচ তিনি দেশ থেকেই পাঠান। অথচ সরকারি চাকরির বাইরে তার আর কোনো বৈধ উপার্জনের উৎস নেই। এমনকি আয়কর ফাইলেও তিনি বসুন্ধরা এলাকার বাড়ির মালিকানা দেখিয়েছেন স্ত্রীর নামে।
সূত্র বলছে, রফিক ২০২২-২৩ অর্থবছরে যৎসামান্য আয় দেখিয়েছেন। কর অঞ্চল-৪ এর দাখিলকৃত আয়কর রিটার্নে তিনি বেতন-ভাতা, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানতের সুদ বাবদ ৯ লাখ ৮৮ হাজার আটশ আশি টাকা আয় দেখান। এছাড়া সম্পদের মধ্যে টঙ্গী পুলিশ হাউজিংয়ে প্লট এবং পুলিশ রিক্রিয়েশন ক্লাব, গুলশানের দি ক্যাপিটাল ক্লাব ও আলোচিত বোট ক্লাবের সদস্যপদ দেখানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসাবে পুলিশের কেউ কোনো ক্লাব বা অন্য কোনো সংগঠনের সদস্য হতে পারে না। এজন্য পুলিশ সদর দপ্তরের পূর্বানুমোদন নিতে হয়। কিন্তু রফিক এসবের কোনো ধার ধারেননি। প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে তিনি একাধিক অভিজাত ক্লাবের সদস্য হন। কিন্তু এসব ক্লাবের সদস্যপদ তিনি কত টাকায় কিনেছেন তার কোনো ব্যখ্যা কোথাও দেওয়া হয়নি।
বেনজীরের আশীর্বাদ : সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের আশীর্বাদে পুলিশ বাহিনীতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন রফিক। এ সময় রফিককে গুলশান এলাকার নিরাপত্তায় এলওসিসি (ল’ এন্ড অর্ডার কো-অর্ডিনেশন কমিটি) নামে গঠিত একটি সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক করা হয়। পরে এ সংক্রান্ত প্রকল্প থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আয়ের সুযোগ তৈরি হলে গুলশান থানার ওসি পদ ছেড়ে রফিক এলওসিসিতে মনোযোগ দেন। এক পর্যায়ে এলওসিসির কার্যালয় গুলশান ফাঁড়িতে স্থানান্তর হলে দিনের বেশির ভাগ সময় তিনি সেখানেই থাকতেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলওসিসির আওতায় সিসি ক্যামেরা বসানোর নামে বিপুল অঙ্কের চাঁদা আদায় করা হয়। এমনকি বিশেষ সহায়তার নামে অর্থ চেয়ে গুলশান এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কাছে চিঠি দেয় পুলিশ। কিন্তু এ খাতে আদায়কৃত অর্থ ব্যয়ের কোনো স্বচ্ছতা ছিল না। এমনকি এ সংক্রান্ত তহবিলের কোনো অডিটও হয়নি। এ নিয়ে খোদ পুলিশ বাহিনী থেকেও বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু বেনজীরের কারণে এসব অভিযোগ শেষ পর্যন্ত তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, শুরুর দিকে প্রকল্পের সঙ্গে সিটি করপোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা যুক্ত থাকলেও বাস্তবে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিল পুলিশের হাতে।
বেনজীরের হয়ে মূলত তৎকালীন গুলশান ওসি রফিক ছিল প্রকল্পের হর্তকর্তা। পরে পদোন্নতি পেয়ে এডিসি (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) হলেও প্রকল্পের দায়িত্ব ছাড়েননি রফিক। এমনকি ভবিষ্যতে রফিক অবসরে গেলেও যাতে সমন্বয়কারী হিসাবে তাকে বহাল রাখা যায় সেজন্য সাংগঠনিক কাঠামোয় পরিবর্তন আনা হয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগের দিন পর্যন্ত এলওসিসির চাবিকাঠি ছিল রফিকের হাতে।
উপহারেই কিস্তিমাত : অভিনব কৌশলে দুহাতে টাকা উপার্জন করলেও সবই ‘উপহার’ বা ভালোবাসার প্রতিদান বলে চালিয়ে দেন রফিক। বিশেষ করে পুলিশের ওপেন হাউস ডে, কমিউনিটি পুলিশিং, উঠোন বৈঠক ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে অনুদানের নামে চাঁদা আদায় করা হয়। কিন্তু আদায়কৃত চাঁদার একটি বড় অংশ যায় রফিকের পকেটে। এছাড়া সাবেক সরকারের আমলে স্পর্শকাতর দিবস হিসাবে পরিচিত ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালনের নামে ব্যাপকভাবে চাঁদা আদায় করা হয়। মূলত রফিকের নেতৃত্বে গুলশানের বাসিন্দাদের কাছে চাঁদা চেয়ে বার্তা দিত পুলিশ।
পুলিশের গুলশান বিভাগের সাবেক এক ডিসি যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন গুলশানে কর্মরত থাকায় বিভিন্ন দূতাবাসে রফিকের অবাধ যাতায়াত ছিল। এছাড়া পেশাগত কারণে দূতাবাসের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি হয়। কিন্তু পরে রফিক এসব যোগাযোগ তার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। এছাড়া বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণে তিনি বিশেষ ভিসা সহায়তা পাইয়ে দেন। এতে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে অনেকের স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন রফিক।
সূত্র বলছে, রফিক নিজেকে আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য বলে পরিচয় দেন। এমনকি তার ভাইদের কয়েকজন আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা-এমন কথাও প্রচার করতেন। এছাড়া সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও শহীদুল হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য ছিলেন রফিক। প্রচলিত বিচারব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে তিনি গুলশান থানায় বসে অনেকটা গ্রাম আদালতের মতো বিশেষ সালিশ প্রথা চালু করেন। এ সময় গভীর রাত পর্যন্ত থানায় সালিশ বৈঠকের নামে বিবদমান পক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।
জানা যায়, নিজেকে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ পুলিশ বলে দাবি করলেও রফিকের পরিবারের কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। বরং সুবিধাবাদী হিসাবে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের নাম ব্যবহার করেন তারা। এছাড়া এলাকায় তাদের পরিবারের তেমন পরিচিতি নেই। রফিকের ভাইদের কয়েকজন নানা পেশায় যুক্ত। রফিক নিজেও এক সময় গার্মেন্টে চাকরি করতেন।
যুগান্তরের মেহেরপুর প্রতিনিধি জানান, রফিকের বাবার নাম নইমুদ্দিন বিশ্বাস ওরফে নায়েব হাজি। মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার যতারপুর গ্রামে তাদের বাড়ি। চার ভাইয়ের মধ্যে রফিক বড়। পুলিশে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি করতেন। ১৯৯০ সালের দিকে তিনি এসআই (উপপরিদর্শক) পদে চাকরি পান। তার অন্য ভাইয়ের মধ্যে একজন প্রবাসী। এছাড়া তার এক ভাই ঢাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন এবং আরেক ভাই গ্রামেই ছোটখাটো ব্যবসা করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করেন।
বক্তব্য : অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম সোমবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ১৯৯৭ সালে মিশন থেকে ফিরে তিনি বসুন্ধরায় জমি কেনেন। পরে সেখানে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর অনুমোদন নিয়ে তিনি ফ্ল্যাট স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করেছেন। তিনি বলেন, আপনারা ভালো করেই জানেন আমি দুর্নীতিবাজ কি না। তারপরও এখন বৈরী সময় যাচ্ছে। অনেকে নানাভাবে কুৎসা রটাতে তৎপর।
সান্তানদের বিদেশে লেখাপড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার এক ছেলে লন্ডনে লেখাপড়া শেষ করে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় চাকরি করে। আরেক ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করছে। তারা দুজনেই মেধাবৃত্তি নিয়ে বিদেশে লেখাপড়া করেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এলওসিসি গঠনের সময় ট্রাস্টি হিসাবে তার নাম রেজিস্ট্রি করা হয়। ফলে এখনো সেখানে তার নাম রয়ে গেছে। গত মাসে তাকে গুলশান থেকে র্যাব ট্রেনিং স্কুলে বদলি করা হয়। তাই কাগজ-কলমে থাকলেও বাস্তবে তিনি এলওসিসি অপারেশনের দায়িত্বে আর নেই।