Logo
Logo
×

শেষ পাতা

প্রস্তাব অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে বন্দি

সঞ্চয়পত্রে মাসিক মুনাফার বিধান আটকে দেন সচিব

মিজান চৌধুরী

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সঞ্চয়পত্রে মাসিক মুনাফার বিধান আটকে দেন সচিব

সব ধরনের গ্রাহকের সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রতি ৩ মাসের পরিবর্তে প্রতি মাসে দেওয়ার বিধানসহ সব ধরনের সংস্কার কর্মসূচি লাল ফিতায় বন্দি। ওই সংস্কারে ‘পেনশন সঞ্চয়পত্র’ ক্রয়সীমা ৫০ লাখ থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টাকা, পরিবার সঞ্চয়পত্রে পুরুষের বয়সসীমা ৬৫ বছর থেকে ৫০-এ নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া ‘বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে’ অনেক বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের রাস্তা করে দিতে বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলো পুনর্বিন্যাস করার উদ্যোগ ছিল।

নানা ধরনের সংস্কারের এ প্রস্তাবটি গত বছর সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে (আইআরডি) পাঠানো হয়। কিন্তু তৎকালীন আইআরডির সিনিয়র সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্যবিদায়ি চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম একক ক্ষমতাবলে এ প্রস্তাব আটকে দেন। ক্ষমতায় থাকার শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পরবর্তীতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে দেননি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সঞ্চয়পত্র খাতে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে কয়েক লাখ উপকারভোগী সহজে লেনদেন করতে পারতেন। মুনাফা প্রতি মাস অন্তর প্রাপ্যসহ এ খাতে বেশি বিনিয়োগ আসার সুযোগ ছিল। যদিও এসব সংস্কার উদ্যোগ আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের পরামর্শে নেওয়া হয়েছিল। পরে তিনিই বাধা হয়ে দাঁড়ান। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর পরিদর্শন করেন। ওই সময় এসব বিষয় তুলে ধরেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। বিষয়গুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব প্রস্তাব আকারে পাঠানোর কথা বলেন। সে আলোকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর সঞ্চয়পত্রের খাতওয়ারি সংস্কারের প্রস্তাব করে। কিন্তু সচিব পরে কেন বেঁকে যান কেউ কিছু বলতে পারছেন না।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সঞ্চয়পত্র খাতে প্রস্তাবগুলো ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনা করা দরকার। এরই মধ্যে দেশের অর্থনীতি, সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন প্রাপ্যতা, সঞ্চয়পত্র ক্রেতার সংখ্যা সবই বেড়েছে। কিন্তু এ খাতের বিধিবিধান ও নিয়মগুলো পরিবর্তন করা হয়নি। এখন যুগোপযোগী করার উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন। কিন্তু নীতিনির্ধারণী মহল থেকে উদ্যোগ নেওয়া না হলে এগোনো সম্ভব হবে না। এছাড়া আরও একটি কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের ঋণের শর্ত হচ্ছে, সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ গ্রহণ করা। সরকার সেটি অনুসরণ করতে গেলে সংস্কার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতই থাকবে বলে তিনি মনে করেন।

বর্তমান চারটি সঞ্চয়পত্রের মধ্যে শুধু ‘পরিবার’ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেওয়া হয় প্রতি মাস অন্তর। এছাড়া ‘৩ মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক’ সঞ্চয়পত্র, পেনশন সঞ্চয়পত্র ও ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেওয়া হয় প্রতি ৩ মাস অন্তর। সংশ্লিষ্টরা জানান, ৩ মাসের মুনাফা একসঙ্গে না দিয়ে প্রতি মাসে দেওয়া হলে উপকারভোগী তা কাজে লাগাতে পারেন। এক্ষেত্রে সুদহার ঠিক রেখেই প্রতি মাসে মুনাফা দেওয়ার বিধান চালু করার প্রস্তাব দেওয়া হয় ওই সংস্কারের আওতায়। এছাড়া বর্তমানে পুরুষ ক্রেতা পরিবার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে হলে সেক্ষেত্রে তার বয়স ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি হতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, একজন সরকারি চাকরিজীবী ৫৯ বছরে অবসরে যান। কিন্তু বয়সসীমা বেশি থাকায় পেনশনের টাকা দিয়ে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না। একই সমস্যা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান সরকারের গড় আয়ু হিসাবে ৬৫ বছরে আগে অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। আর বেঁচে থাকা মানুষগুলোর ওই বয়সে পৌঁছানোর পর টাকার খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। সব দিক বিবেচনা করে পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনার বয়সসীমা ৬৫ থেকে কমিয়ে ৫০ বছরে নামিয়ে আনার যৌক্তিকতা তুলে ধরে সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর।

বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্র সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকায় কেনা যায়। এ সঞ্চয়পত্র বাংলাদেশি নাগরিক ১৮ বছর বা তার বেশি মহিলা, শারীরিক প্রতিবন্ধী পুরুষ ও মহিলা এবং ৬৫ বছর ও তার বেশি পুরুষ ও মহিলা কিনতে পারেন।

সূত্রমতে, পেনশন সঞ্চয়পত্র ক্রয়সীমা ৫০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টাকার বিধান আছে। যা এক কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। অথবা একজন চাকরিজীবী অবসরে যাওয়ার পর তার ভবিষ্যৎ তহবিল ও আনুতোষিক মিলে মোট যে টাকা তার সমপরিমাণ দিয়ে কিনতে পারবেন পেনশন সঞ্চয়পত্র। উল্লিখিত দুটির যে কোনো একটি সুযোগ নিতে পারবেন এক পেনশন সঞ্চয়পত্র ক্রেতা। এমন প্রস্তাব অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ দিয়েছে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, পেনশন সঞ্চয়পত্র কেনার সিলিং যখন নির্ধারণ করা হয় ওই সময় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতার অঙ্ক কম ছিল। এরপর ২০০৯ এবং ২০১৫ সালে চাকরিজীবীদের দুটি পে-স্কেল দিয়েছে সরকার।

এখন একজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা অবসরে গেলে আনুতোষিক ৫০ লাখ টাকার উপরে পাচ্ছেন। এর সঙ্গে ভবিষ্যৎ তহবিল যোগ করলে তা এক কোটি টাকার বেশি হচ্ছে। কিন্তু পেনশন সঞ্চয়পত্র কেনার সিলিং কম থাকায় অবসরে যাওয়া চাকরিজীবীরা পেনশনের পুরো টাকা দিয়ে ইচ্ছে থাকলেও এ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না।

এছাড়া একজন চাকরিজীবী অবসরে গেলে তার বেতন ৬৫ শতাংশ কমে যায়। যিনি ৩০ হাজার টাকা বেতন পেয়েছেন, পেনশনে গেলে পরের মাস থেকে পাবেন ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। তার ঘাটতি মেটানোর কোনো সুযোগ থাকে না। অথচ এ সময়ে তার খরচও কমছে না। যদিও বিনিয়োগের জন্য শেয়ার বাজার বা ব্যাংক আছে। কিন্তু পুঁজি বাজারের ঝুঁকি নিয়ে অনেকে বিনিয়োগ করতে সাহস পান না। ব্যাংকে আমানতের সুদ কম থাকায় সেখানেও বিনিয়োগ করেন না। আয়ের ঘাটতি মেটাতে পেনশনের টাকা দিয়ে একমাত্র সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন বেশি। কারণ এ খাতটিকে তারা নিরাপদ মনে করেন। এজন্য পেনশন সঞ্চয়পত্রের ক্রয়সীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বর্তমান পেনশন সঞ্চয়পত্র একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ (পঞ্চাশ) লাখ টাকা পর্যন্ত কেনা যায়। তবে সে অর্থের পরিমাণ আনুতোষিক ও সর্বশেষ ভবিষ্যৎ তহবিল হতে প্রাপ্ত অর্থের বেশি নয়। বর্তমান আয়কর বিধিমালায় স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলের ৫০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করার বিধান আছে। খাতগুলো হচ্ছে-মৎস্য, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, ব্যাঙ, দুগ্ধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং রেশম গুটিপোকা পালনের খামার, পোলট্রি ফিডস উৎপাদন, বীজ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান। এছাড়া স্থানীয় উৎপাদিত বীজ বিপণন, উদ্যান প্রকল্প, ছত্রাক উৎপাদন এবং ফল ও লতাপাতার চাষ হতে অর্জিত আয় দিয়ে বিনিয়োগ করা যায়। তবে সে আয় সংশ্লিষ্ট উপ-কর কমিশনার কর্তৃক প্রত্যয়নকৃত হতে হবে।

সূত্রমতে, এসব ক্ষেত্র থেকে কিছু বাতিল করা হবে। পাশাপাশি বর্তমানে অনেক নতুন ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত হবে। সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বিধিবিধানে না থাকায় অনেক নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা যাচ্ছে না। সঞ্চয়পত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম