প্রস্তুত যাত্রাবাড়ী থানা
সপ্তাহের মধ্যে ফের নিজস্ব ভবনে কার্যক্রম
যাত্রাবাড়ী (ঢাকা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অন্ধকার ভূতুড়ে স্থাপনা থেকে আলোকিত যাত্রাবাড়ী থানা ভবন। এ যেন এক নতুন ভবন। থানার ভেতর এবং বাইরে নজর করলে তাই মনে হয়। ২ মাস ধরে যেন অন্ধকার এক ভূতুড়ে স্থাপনা ছিল। ভবনের ভেতরে বাইরে ছিল ক্ষত-বিক্ষত ধ্বংসস্তূপ। থানা ভবনে, নালায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল অস্ত্র, গুলির খোসা, সাউন্ড গ্রেনেড, পুলিশের পোশাক, হেলমেট, জুতা, মোজা এবং ছাত্র-জনতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লাশ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে জুলাই-আগস্টে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দফায় দফায় হামলা মুহুর্মুহু গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকশ মানুষ গুলিবিদ্ধ ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রক্তাক্ত হয়। তাদের মধ্যে কেউ ঘটনাস্থলে মারা যান, অনেককে হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়। আহত হন শতশত লোক।
যার রেশ পড়ে শেখ হাসিনার ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবরে। খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা যাত্রাবাড়ী থানা ঘেরাও করেন। বিকাল ৫টা নাগাদ যাত্রাবাড়ী থানায় অবরুদ্ধ পুলিশের একটি দল গুলি করতে করতে থানা থেকে বের হয়ে যায়। তবে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ভেতরে আটকা পড়েন। বিক্ষুব্ধ জনতা তখন থানার ভেতরে ঢুকে যায়। ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ সময় জনরোষে পড়ে চার পুলিশ সদস্য মারা যান। সবশেষ থানা ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় যাত্রাবাড়ি থানা ভবন। ভবনের সব আসবাবপত্র পুড়ে যাওয়া ছাড়াও দেওয়ালের বেশিরভাগ পলেস্তারা খসে পড়ে। লুটপাট করা হয় থানার আসবাবপত্র থেকে পুলিশের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। এ ছাড়া থানা গেটের ভেতরে ও থানার সামনে রাস্তায় থাকা পুলিশের জলকামানসহ বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। থানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। পরিবেশ না থাকায় থানার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
৮ আগস্ট অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৯ আগস্ট স্বল্প পরিসরে ডেমরা থানার তৃতীয় তলায় একটি কক্ষে যাত্রাবাড়ী থানার ডিউটি অফিসারের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সেখানেই জিডি ও অভিযোগ করে আসছেন ভুক্তভোগীরা।
যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, থানায় হামলা, লুটপাট ও আগুনের ঘটনায় অন্তত ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে থানার সাতটি গাড়ি, তৎকালীন এসি ও এডিসির গাড়িসহ নয়টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাইরে থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের গাড়িও সেদিন আগুনে পুড়ে যায়। থানার ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যদের মোটরসাইকেল, আলামত হিসেবে জব্দ করে আনা গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। থানার পূর্ব পাশে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ভবনের সামনে থানার অন্তত ৩৫টি গাড়ি রাখা ছিল, সেগুলোতেও আগুন দেওয়া হয়। আগুনের কারণে থানার রেজিস্টার, মামলার নথি, কম্পিউটার সবকিছুই পুড়ে গেছে।
পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের কনস্ট্রাকশন বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সুজন আলী যুগান্তরকে বলেন, থানা ভবনের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত প্রতিটি কক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। ছাদের পলেস্তারা থেকে স্যানিটারি ব্যবস্থা সবই নষ্ট হয়ে গেছে। ভবনের মূল কাঠামো ছাড়া আর কিছুই ঠিক ছিল না। এক কথায় পুরো ভবনে নতুন করে সংস্কার করতে হয়েছে। ২২ আগস্ট থেকে সংস্কার কাজ শুরু করা হয়েছে। দুই মাস ধরে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত দেড়শ শ্রমিক কাজ করছেন। মূল ভবনের সংস্কার কাজ প্রায় ৯৮ ভাগ শেষ। ব্যারাক ভবন, মসজিদ, সীমানা প্রাচীরসহ অন্যান্য স্থাপনার কাজ পুরোপুরি শেষ হতে আরও ৮-১০ দিন সময় লাগতে পারে।
যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফারুক আহম্মেদ যুগান্তরকে বলেন, ৫ আগস্টের আগে যাত্রাবাড়ী থানায় জনবল ছিল ২৫৮ জন। তাদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ছিলেন ২০৬ জন ও আনসার সদস্য ছিলেন ৫২ জন। এখন এ থানার পুলিশ সদস্যদেরও বদলি করা হচ্ছে। বর্তমানে ১৬০ জন পুলিশ সদস্য রয়েছে এ থানায়। তিনটি গাড়ি দেওয়া হয়েছে। তা দিয়েই থানা এলাকায় টহলসহ অন্যান্য কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ডেমরা থানার তৃতীয় তলায় একটি কক্ষে যাত্রাবাড়ী থানার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সেখানে নিয়মিত জিডি ও অভিযোগ নিয়ে আসছেন মানুষ। আশা করছি ৬-৭ দিনের মধ্যেই যাত্রাবাড়ী থানার আগের ভবনেই কার্যক্রম চালু করা যাবে।
ওয়ারী বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ছালেহ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, থানা ভবনের সংস্কার কাজ প্রায় শেষের দিকে। ৫-৭ দিনের মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানা ভবন থেকেই পুনরায় কার্যক্রম চলতে পারে।