জেলা পর্যায়ে হাই-টেক পার্ক স্থাপন
তিন বছরের প্রকল্প যাচ্ছে ১০ বছরে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও ‘জেলা পর্যায়ে আইটি বা হাইটেক পার্ক স্থাপন’ প্রকল্প এখন ১০ বছরে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৬ শতাংশ। এখন আবার নতুন করে মেয়াদ ৩ বছর বাড়ানো হচ্ছে। ব্যয় বাড়ছে ২ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। ফলে মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৪ হাজার ১৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অথচ এ প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ১ হাজার ৭৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে এক দফায় বাড়ানো হয়েছে ৪৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এদিকে আজ বুধবার পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় দ্বিতীয় দফায় ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব উঠছে। এটি অনুমোদন হলে মেয়াদ ৩ বছর এবং ব্যয় ২ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বাড়ানোর সুপারিশ যাবে একনেক বৈঠকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটিতে অধিকাংশ অর্থের জোগান দিচ্ছে ভারত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ার পেছনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ও এক্সিম ব্যাংকের দায় সবচেয়ে বেশি। কেননা শুরু থেকেই তারা বারবার ব্যাখ্যা চাওয়ার ফাঁদে ফেলে প্রকল্পের গতি থামিয়ে দিয়েছে। অথচ তাদের ঋণের সুদের হার যেমন বেশি, তেমনি শর্তও কঠিন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি গতকাল (সোমবার) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিবকে এই প্রকল্পের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি জানিয়েছেন কিছু জটিলতা আছে তবে সেগুলো কেটে যাবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দায় কোন পক্ষের সেটি ওইভাবে বলা ঠিক হবে না। তবে ভারতীয় ও বাংলাদেশ উভয় অংশের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়। আশা করছি সব জটিলতার অবসান হয়ে যাবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, জেলা পর্যায়ে আইটি বা হাইটেক পার্ক স্থাপন প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১ হাজার ৭৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ২৫২ কোটি ৪০ লাখ এবং ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের ঋণ ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। পরে প্রকল্পের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। এ পর্যায়ে শুধু সরকারি অংশের অর্থ বেড়েছিল। এবার দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে ২ হাজার ৩৫১ কোটি ৭১ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এতে ব্যয় বাড়ছে ১২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এছাড়া প্রস্তাবিত বাড়তি ব্যয়ের মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ হাজার ৭৪৬ কোটি ৭১ লাখ এবং ভারতীয় ঋণের বাড়ছে ৬০৫ কোটি টাকা।
এদিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর। এর মধ্যে ব্যয় না বাড়িয়ে একবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এক বছর। প্রথম সংশোধনীতে বাড়ানো হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর। এখন দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে তিন বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ করার কথা বলা হয়েছে। গত জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৬২৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১২৯ কোটি ৩৩ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণের ৪৯৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৯২ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৩৬ শতাংশ।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এ প্রকল্পের বেশির ভাগ সমস্যা ভারতীয় পক্ষের। কেননা তাদের মধ্যে আমলাতান্ত্রিকতা আছে। এমনকি এক্সিম ব্যাংকেও এই আমলাতান্ত্রিকতা। এছাড়া তাদের কাছে কোনো কাগজ পাঠালে তারা সেগুলো যাচাই-বাছাই করে। কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলে বাংলাদেশ অংশ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়ার পর আবারও সেই ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এভাবে কালক্ষেপণ করে। এখানে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কোনো গাফিলতি ছিল না। শুধু এই প্রকল্পে নয়, ভারতীয় ঋণের অন্যান্য প্রকল্পের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।
দ্বিতীয় সংশোধনের কারণ এবং প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ার বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের আওতায় আইসিটি পার্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় জমি বরাদ্দ ও অধিগ্রহণে দেরি হয়েছে। এছাড়া দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব এবং দরদাতাদের অংশগ্রহণের অভাবে পুনঃদরপত্র আহ্বান করতে হয়েছে। পাশাপাশি ভারতীয় পরামর্শক সংস্থা ১২টি জেলায় প্যাকেজের ডিজাইন ও প্রাক্কলন সরবরাহে দেরি করেছে। এলওসি (লাইন অব ক্রেডিট) চুক্তি অনুসারে প্রকল্পের সব দরদাতা শুধু ভারতীয় হতে হবে। দরদাতাদের হার্ডফাইলে দরপত্র জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারির সময় বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত বন্ধ থাকায় সেটি জমা দিতে পারেনি। পরে ভারতের সম্ভাব্য দরদাতাদের বিশেষ অনুরোধে ইতোমধ্যে দরপত্র জমাদানের সময় ১০ বার বৃদ্ধি করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, দ্বিতীয় এলওসি চুক্তি অনুসারে ৭৫ শতাংশ সরঞ্জাম বা উপকরণ ভারত থেকে আমদানির কথা। দরদাতারা এই বিষয়টি কমিয়ে ৫০ শতাংশ করার অনুরোধ করেন। ভারতীয় হাইকমিশন ও এক্সিম ব্যাংক এটিকে ৬৫ শতাংশে কমিয়ে আনতে সম্মত হয়। এখন অনুপাত দাঁড়িয়েছে ভারত থেকে ৬৫ এবং বাংলাদেশ থেকে ৩৫ শতাংশ। এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন। এলওসির চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারত থেকে যে ৬৫ শতাংশ পণ্য আমদানি করা হবে তার কাস্টমস শুল্ক, ভ্যাট এবং আয়কর বাংলাদেশ সরকারকে দিতে হবে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারি খাতে প্রায় ১ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আরও বলেছেন, মেয়াদ বাড়ানোর কারণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের খরচ বেড়েছে। এছাড়া মেয়াদ বেড়ে যাওয়ায় বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য ব্যয়ও বাড়বে। পাশাপাশি প্রকল্পের ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ৬টি জেলায় সিনেপ্লেক্স ভবন ও ৩টিতে ডরমেটরি ভবন নির্মাণের সংস্থান রয়েছে। কিন্তু ২০১৮ সালের রেট শিডিউলে এসব ব্যয় প্রাক্কলন করা। এখন ২০২২ সালের রেট শিডিউল ধরে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।