বিএসসির আরেক জাহাজে অগ্নিকাণ্ড
৪৭ ক্রু জীবিত উদ্ধার এক স্টুয়ার্ডের মৃত্যু
চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পাঁচ দিনের মাথায় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন আরও একটি তেলবাহী জাহাজে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এ ঘটনায় ছাদেক মিয়া নামে জাহাজে কর্মরত এক স্টুয়ার্ডের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার রাত ১২টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী ‘এমটি বাংলার সৌরভ’ জাহাজে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এদিকে রাষ্ট্রীয় এই জাহাজটিতে ‘অগ্নিকাণ্ডকে’ নাশকতা হিসাবে দেখছেন বিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। শনিবার সকাল ১০টায় বিএসসি সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের এমডি কমোডর মাহমুদুল মালেক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত নাশকতা’ ও জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অপচেষ্টার অংশ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিএসসির কর্মকর্তারা জানান, শুক্রবার ১২টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় ‘এমটি বাংলার সৌরভ’ জাহাজে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। জাহাজের বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়। এ সময় ৪৭ জন ক্রু জাহাজে কর্মরত ছিলেন। আগুন দেখে তাদের সবাই দিশেহারা হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে জীবন বাঁচাতে অনেকে সাগরে ঝাঁপ দেন। খবর পেয়ে নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে গিয়ে জাহাজের আগুন নেভাতে নেমে পড়েন।
কোস্ট গার্ড সূত্র জানায়, আগুন লাগার খবর পেয়ে কোস্ট গার্ডের টাগবোট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ৪০ মিনিটের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে নৌবাহিনী এবং চট্টগ্রাম বন্দরের টাগবোটও আগুন নেভাতে যোগ দেয়। জাহাজটিতে ৪০ জন ক্রুসহ ৪৮ জন কর্মী ছিলেন। ১৪ জন কর্মী পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন এবং বাকিরা জাহাজে ছিলেন। কোস্ট গার্ড সফলভাবে বাংলার সৌরভ থেকে ৩৭ জন কর্মীকে উদ্ধার করে, অন্যদের সমুদ্র এবং সৈকতের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়। আশপাশে অবস্থান করা জেলে নৌকাও বিপদগ্রস্ত ক্রুদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। এর মধ্যে আহত স্টুয়ার্ড ছাদেককে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয়রা সাগরে অবস্থানরত তেলের ট্যাংকারটিতে আগুন লাগার খবর জানান। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট সেখানে যায়। জাহাজটি মাঝ সাগরে থাকায় তাদের আর ঘটনাস্থলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কীভাবে আগুন লেগেছে সেটি জানা যায়নি। সংবাদ সম্মেলনে বিএসসির এমডি কমোডর মাহমুদুল মালেক বলেন, কয়েকদিন আগে বাংলার জ্যোতিতে আগুন লেগেছিল। এরপর আগুন লাগল বাংলার সৌরভে। তাই আমরা ধারণা করছি, এ ঘটনা জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলার অপচেষ্টা। এ ঘটনায় কারা জড়িত তা শনাক্ত করা উচিত। বাংলার সৌরভ জাহাজের সম্মুখ অংশ থেকে একই সঙ্গে চার জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। অথচ জাহাজে কোনো বিস্ফোরণ হয়নি। যখন জাহাজে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে ঠিক একই সময়ে পাশ দিয়ে একটি স্পিডবোটও যায়। যেহেতু গ্যাস ফর্ম কিংবা অন্য কোনো কারণে আগুন লাগার ঘটেনি তাই আমরা ধারণা করছি, এটি নাশকতামূলক অগ্নিকাণ্ড হতে পারে। কিন্তু সবকিছু তদন্তের পরই জানা যাবে।’
বিএসসির এমডি আরও বলেন, জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের সময় সমুদ্র খুব উত্তাল ছিল। বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যে নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাতটি টাগবোট একযোগে অপারেশন পরিচালনা করে। প্রায় দেড় ঘণ্টায় অগ্নিনির্বাপণ করার পর বাতাসের কারণে সামনের দিকের ভেতর থেকে আবার আগুন জ্বলে ওঠে। জাতীয় জ্বালানির জন্য ব্যাক টু ব্যাক (পরপর) এ ধরনের দুটি ঘটনা হুমকিস্বরূপ বলে সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন তিনি। জাহাজটিতে ১১ হাজার ৫৫ টন তেল ছিল। মারা যাওয়া ছাদেক মিয়ার বাড়ি নোয়াখালী এলাকায়। তীরে পৌঁছানোর পরও তার জ্ঞান ছিল। ট্রমাজনিত কারণে হাসপাতালে নেওয়ার পথে বা হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের কেউ তেমন আহত হননি।
দুই জাহাজে অগ্নিকাণ্ড নাশকতা নাকি অব্যবস্থাপনা : মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন তেলবাহী দুই জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। গত সোমবার পতেঙ্গা ডলফিন জেটিতে তেল খালাসের সময় অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় বিএসসির অয়েল ট্যাংকার ‘বাংলার জ্যোতি’। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় শুক্রবার গভীর রাতে বন্দরের বহির্নোঙরে সংস্থাটির অপর ট্যাংকার বাংলার সৌরভে ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। বাংলার জ্যোতির তিন নাবিক ও বাংলার সৌরভের এক নাবিকসহ এ দুটি ঘটনায় মারা গেছেন চারজন। কাছাকাছি সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির দুটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে-এটা কি আসলেই দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা। বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক অবশ্য শনিবার সংবাদ সম্মেলনে নাশকতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি পরপর দুটি অয়েল ট্যাংকারে অগ্নিকাণ্ড জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তবে শিপিং সেক্টর সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলছেন, প্রথমেই দেখতে হবে ৩৭ বছরের পুরনো জাহাজ দুটি পরিচালনায় বিএসসির কোনো অব্যবস্থাপনা ছিল কিনা। তারপর আসে নাশকতার প্রশ্ন। নাশকতার প্রসঙ্গ এনে অব্যবস্থাপনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। নাশকতা বা অব্যবস্থাপনা যাই ঘটুক না কেন, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এদিকে তেল পরিবহণে নিয়োজিত থাকা বিএসসির দুটি জাহাজই অগ্নিকাণ্ডে অকেজো হয়ে যাওয়ায় তেল পরিবহণ নিয়ে সংকটে পড়বে সংস্থাটি। এই দুটি জাহাজ বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে তেল খালাস করে তা ইস্টার্ন রিফাইনারির ডিপোতে নিয়ে আসত।