Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ভাঁওতাবাজি চলবে না-হুঁশিয়ারি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার

বাধ্য হয়ে মাঠে নামলেন নারকোটিক্স ডিজি

অভিযানের তথ্য প্রতিদিন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ

Icon

তোহুর আহমদ

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাধ্য হয়ে মাঠে নামলেন নারকোটিক্স ডিজি

‘ভাঁওতাবাজি করবেন না’ বলে কঠোর ভাষায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উদ্দেশে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি উচ্চারণের পর সংস্থাটির কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেছেন। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এমনকি দলবলসহ খোদ মহাপরিচালক (ডিজি) নিজেই মাঠে নেমেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নারকোটিক্সের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি সংস্থাটির সার্বিক কার্যক্রম দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে তিনি সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে মাদকবিরোধী অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আলোচনার একপর্যায়ে মাদকবিরোধী অভিযানের ক্ষেত্রে নারকোটিক্সের বেশকিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে জনবল সংকট এবং অস্ত্রবিহীন খালি হাতে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকির কথা বলা হয়। কিন্তু উপদেষ্টা এগুলোকে দায় এড়ানোর কৌশল বলে মন্তব্য করেন। এমনকি বৈঠকে উপস্থিত মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘কোনো ধরনের ভাঁওতাবাজি করবেন না। এসব বন্ধ করেন।’ বসে না থেকে যতটুকু সক্ষমতা আছে তা দিয়েই মাদকের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন তিনি।

একপর্যায়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা উপস্থিত সবাইকে সাবধান করে বলেন, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম চলবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজ হিসাবে পরিচিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো ধরনের আনুকূল্য দেখানোর সুযোগ নেই। তাদের অপরাধী হিসাবে গণ্য করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে গ্রেফতার করে আইনের হাতে তুলে দিতে হবে।

পরে উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারের বেশকিছু সংস্কার পরিকল্পনা তুলে ধরে বলেন, অস্ত্র না থাকায় খালি হাতে মাদকবিরোধী অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই ঝুঁকি রয়েছে। এজন্য ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশ সঙ্গে নিতে হবে। তবে কোনো অজুহাত দেখিয়ে বসে থাকা যাবে না। অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও ঝুঁকি ভাতার বিষয়ে শিগগিরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

ডিএমপি এলাকায় তাৎক্ষণিক অভিযানের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে সার্বক্ষণিক ২০ সদস্যের পুলিশ টিম দেওয়া আছে। তবে অভিযানে গিয়ে নারকোটিক্সের কর্মকর্তারা স্বর্ণালঙ্কার লুটসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়লে পুলিশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, ১৭ সেপ্টেম্বর আলোচিত এ বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা চলে যাওয়ার পর অধিদপ্তরজুড়ে নানা আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে প্রকাশ্য সভায় কড়া ভাষায় তিরস্কার এবং ‘ভাঁওতাবাজি’ শব্দ প্রয়োগ নিয়ে আপত্তি তোলেন কয়েকজন। অবশ্য এ নিয়ে সমালোচনার রেশ বেশিদূর বাড়তে দেননি মহাপরিচালক। সমালোচনামুখর কয়েকজন কর্মকর্তাকে তিনি নিজের কক্ষে ডেকে নেন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজেদের আত্মসমালোচনা ও উপদেষ্টার নির্দেশ পালনের তাগিদ দেন। একপর্যায়ে রাত থেকেই মাঠে নামে নারকোটিক্স। একযোগে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। এতে একাধিক মাদকের গডফাদারকে গ্রেফতার করা হয়। এমনকি স্বয়ং ডিজি নিজেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন।

উত্তরায় অভিযান : ২৬ সেপ্টেম্বর খোদ মহাপরিচালকের নেতৃত্বে রাজধানীর উত্তরায় কিং ফিশার রেস্টুরেন্ট ও লেকভিউ নামের মদের বারে অভিযান চালায় নারকোটিক্স। এতে বড় ধরনের সফলতা আসে। বারের ভূগর্ভস্থ গোপন সুড়ঙ্গ এবং সেপটিক ট্যাংকের ভেতর থেকে কোটি টাকা মূল্যের বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করা হয়। গভীর রাত পর্যন্ত চলা অভিযানের পুরো সময় মহাপরিচালক ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।

সূত্র জানায়, নারকোটিক্সের লাইসেন্সপ্রাপ্ত মদের বার থেকে এত বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ উদ্ধারের ঘটনায় মহাপরিচালক বিস্মিত হন। তিনি এ বিষয়ে সার্কেল ইন্সপেক্টরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করেন। এমনকি এর পেছনে জড়িত দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট সদস্যদের খুঁজে বের করতে বলেন তিনি। এ সময় উপস্থিত কর্মকর্তারা মহাপরিচালককে বলেন, কাগজে-কলমে নিয়মিত বার পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও বাস্তবে এর কিছুই নেই। বার মালিকরা মোটা অঙ্কের মাসোহারায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে ম্যানেজ করে। এমনকি ঘুসের টাকার ভাগ নিয়মিত উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পকেটেও পৌঁছে যায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে মহাপরিচালক কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বলেন। এছাড়া মহাপরিচালকের নির্দেশনায় গুলশান এলাকার সুইট ড্রিম নামের অপর একটি বারে অভিযান চালিয়ে বিপুল মদ-বিয়ার পাওয়া যায়। এর বাইরে বনানী ১১ নম্বর রোডে প্ল্যান বি নামের মদের বারে অভিযান চালায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

মোবাইল বন্ধ : সম্প্রতি অভিযানকালে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করছে নারকোটিক্স। তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় খোদ রেইডিং পার্টির সদস্যদেরও মোবাইল ফোন ব্যবহার সীমিত রাখতে বলা হচ্ছে। এমনকি সন্দেহ হলে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া অভিযান চালানোর আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল সম্পর্কে এক ধরনের গোপনীয়তা অবলম্বনের কৌশল নিয়েছেন।

এমন কড়াকড়ির কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারকোটিক্সের এক উপ-পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, সর্ষের মধ্যেই ভূত রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খোদ নারকোটিক্সের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিশেষ সখ্য থাকায় অভিযানের তথ্য আগাম ফাঁস হয়ে যায়। এ কারণে ঢাকঢোল পিটিয়ে মাঠে নামলেও নিষ্ফল অভিযান শেষে খালি হাতে ফিরতে হয়। এ নিয়ে অন্য সহযোগী সংস্থার লোকজন বিদ্রুপ ও হাসাহাসি করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আগে নারকোটিক্সের অভিযান অনেকটা ঢিলেঢালা ধরনের হলেও বর্তমানে সেই অবস্থা নেই। এখন অভিযানের সময় যাকে-তাকে ঘটনাস্থলে প্রবেশ বা ছবি-ভিডিও ধারণ করতে দেওয়া হচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ে রিপোর্টিং, স্বচ্ছতা ও গণমাধ্যমে পাঠানোর জন্য শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দিয়ে ছবি তোলা ও ভিডিও ধারনের নিয়ম চালু করা হয়েছে।

তালিকা : মাদক গডফাদার ছাড়াও অবৈধ মদ ব্যবসায় জড়িত মদের বার, সিসা লাউঞ্জ ও মাদক চোরাকারবারিদের তালিকা ধরে অভিযান চালাচ্ছে নারকোটিক্স। এছাড়া রাজধানীর বেশ কয়েকটি মদের বারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এগুলোতে পুলিশ-র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় যৌথ অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, রাজধানীর লাইসেন্সধারী বারগুলোর বেশিরভাগই আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি মদ চোরাকারবারে জড়িত। তারা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা বিদেশি মদ বিয়ার প্রকাশ্যে বিক্রি করে আসছে। এছাড়া নিয়ম লঙ্ঘন করে গভীর রাত পর্যন্ত বার খোলা রাখায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এমনকি বেশ কয়েকটি বারে নিয়মিত ডিজে পার্টি ও সিসা পরিবেশনের ফলে সামাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারকোটিক্সের এক অতিরিক্ত পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, বেশ কয়েকজন বার ও সিসা লাউঞ্জের মালিকসহ মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকে সাবেক সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে রীতিমতো বেপরোয়া ছিলেন। প্রচলিত আইন ও নিয়মের কথা বলতে গেলে তারা উলটো নারকোটিক্সের লোকজনকে চাকরি খাওয়ার ভয় দেখাতেন। তবে সরকার পতনের পরপরই এদের কয়েকজন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সূত্র জানায়, শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে রাজধানীর বনানীতে একাধিক সিসা লাউঞ্জ খুলে সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত নানা অপকর্ম চলে। বিশেষ করে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের মেয়ে শেখ ফারিয়ার নামে বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর ট্যাপটেলস ও ১১ নম্বর রোডে ফারেনহাইট নামে দুটি সিসা লাউঞ্জ চালু হয়। কিন্তু অভিযান দূরের কথা উলটো সেখানে নিরাপত্তা ডিউটি করত পুলিশ। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে সিসা লাউঞ্জ দুটি বন্ধ রয়েছে।

নারকোটিক্স বলছে, প্রচলিত মাদক আইনের ফাঁক গলে আসামিদের জামিন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই চলমান অভিযানে মাদক গডফাদারদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় অর্থ পাচার আইনের ধারা সংযুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মদ-বিয়ার চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। এছাড়া বার লাইসেন্স বাতিল ও অবৈধ সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে খোদ সংস্থা প্রধানের মাঠে নামা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নারকোটিক্স মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এটা করা হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের উজ্জীবিত রাখার জন্য। কারণ সংস্থা প্রধান নিজেই যদি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকেন তাহলে অভিযানে গতি আসে। এছাড়া প্রভাবশালীদের কেউ অন্যায়ভাবে ফোন করে বা অন্যভাবে তদবির করতে পারে না। দায়িত্বপ্রাপ্তরা সঠিকভাবে কাজ না করায় বাধ্য হয়ে দপ্তর প্রধানকে মাঠে নামতে হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে মহাপরিচালক বলেন, না এটা তেমন নয়। তবে আসল কথা হচ্ছে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই। সরকার ঘোষিত জিরো টলারেন্স। সবাই মিলে আমরা সেটাই করতে চাইছি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম