কাকলি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ
অধ্যক্ষের স্থায়ী বহিষ্কার ও দুর্নীতির তদন্তের দাবি * স্কুলে ২ ঘণ্টা অবরুদ্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর ধানমন্ডির কাকলি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ দীন মোহাম্মদ খানের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, অতিরিক্ত টাকা আদায়, স্বেচ্ছাচারিতা, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোসহ নানা অভিযোগ ওঠেছে। তাকে অপসারণ ও দুর্নীতি তদন্তের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। বুধবার দুপুরে প্রতিষ্ঠানের সামনে মানববন্ধন করেন তারা। এরপর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্লাসে গেলে গেটে তালা লাগিয়ে দিয়ে তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন অধ্যক্ষের লোকজন। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দীন মোহাম্মদ খান।
মানববন্ধনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলেন, অধ্যক্ষ দীন মোহাম্মদ খান স্কুলে যোগদানের পর থেকে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে তিনি লাপাত্তা হয়ে যান। এখন স্বপদে ফেরার চেষ্টা করছেন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ইতঃপূর্বে স্কুল কমিটির কাছে তার আর্থিক অনিয়ম এবং শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ঘুস লেনদেনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কয়েকজন শিক্ষকসহ সিন্ডিকেট করে অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যান। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায়, বিনা রসিদে অর্থ আদায়, ভুয়া বিল করে টাকা আত্মসাৎ, কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে অবিলম্বে অধ্যক্ষকে স্থায়ীভাবে অপসারণ, স্কুলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানাই।
মানববন্ধন শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্লাসে গেলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন মিঠুন তার লোকজন নিয়ে স্কুলের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন। এ সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রায় ২ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিল। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে তালা ভেঙে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের করা হয়।
সূত্র জানায়, অধ্যক্ষ দীন মোহাম্মদ খান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দলটির নেতাদের সঙ্গে সখ্য কাজে লাগিয়ে তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার করে আসছেন। ৭ বছর ধরে একজন চেয়ারম্যানের মাধ্যমে এডহক কমিটি করে কোনো গভর্নিং বডি ছাড়াই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার তাপস এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২ সেলিমা খাতুনের (সাবেক সভাপতি কাকলি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ) ছত্রছায়ায় স্কুলে এক ধরনের আতঙ্কজনক পরিবেশ তৈরি করেন এ অধ্যক্ষ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনে পর থেকে তাকে আর স্কুলে দেখা যায়নি। তবে আশ্চর্যজনকভাবে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর রয়েছে তার।
সূত্র আরও জানায়, ৫ আগস্টের পর প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকের সমন্বয়ে শৃঙ্খলা কমিটিসহ বিভিন্ন উপকমিটি করা হয়। সেখানে দীন মোহাম্মাদ খানের অনিয়মের বিষয় ওঠে আসে। প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী, বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি ভার্সন এবং কলেজ শাখা থেকে ভর্তি ফি, ডায়েরি, পরীক্ষার ফি ও অন্যান্য বাবদ প্রায় এক কোটি ৭৯ লাখ ১৩ হাজার টাকা আয় হয়। আগস্ট পর্যন্ত স্কুলের ব্যয় দেখানো হয় ৮৯ লাখ ৬ হাজার টাকা। বাকি টাকা স্কুলের হিসাবে নেই। অথচ এত আয় হওয়ার পরও শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন দেননি দীন মোহাম্মাদ। এছাড়া শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা জমা আছে মাত্র ১১ লাখ। অফিসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে শিক্ষকদের বেতন থেকে এ বাবদ টাকা কাটা হয়। বর্তমানে এ খাতে এক কোটি টাকার বেশি থাকার কথা। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কোনো অডিট রিপোর্ট ও আয়-ব্যয়ের হিসাব নেই। এমপিও ভুক্ত করার নাম করে শিক্ষকদের কাছ থেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুস নিয়েছেন তিনি।
সূত্র আরও জানায়, শিক্ষার্থীদের কাছে জোর করে অতিরিক্ত পাঠ্যবই, ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ও স্কুল ড্রেস বিক্রি করা, পরীক্ষার অতিরিক্ত ফি আদায়, স্কুলের টাকা এফডিআর করে মুনাফা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্কুলের একটি শাখার জমি (ভবনসহ) বিক্রি করে দেন। এই টাকার সঠিক হিসাব দেননি তিনি।
সূত্রের দাবি, অধ্যক্ষ দীন মোহাম্মদ স্কুলে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এক শিক্ষিকার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরে তাকে বিয়ে করেন। এটি তার দ্বিতীয় বিয়ে। দ্বিতীয় স্ত্রীকে প্রতিষ্ঠানের বাংলা মিডিয়ামে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন। এছাড়া ইংরেজি ভার্সনের কোঅর্ডিনেটর হিসাবে এক শিক্ষিকাকে তৃতীয় স্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেন।
সূত্র আরও জানায়, এখন তিনি রাজনীতির ভোল পালটানোর চেষ্টা করছেন। শুক্রবার রাতে ছাত্রদলের নেতাকর্মী নিয়ে স্কুল দখল করার চেষ্টা করেন। এ সময় শিক্ষক ও অভিভাবকরা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ধানমন্ডি মডেল থানায় অভিযোগ করেন। এদিকে হাসিনা সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিন পলাতক থাকায় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ শিক্ষিক মোরশেদা বেগমকে ৮ আগস্ট ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ দেন। সম্প্রতি দীন মোহাম্মদ হাইকোর্টে করা একটি রিট পিটিশনের কপি দিয়ে ব্যানার তৈরি করে স্কুলের সামনে ঝুলিয়ে দেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে দীন মোহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো সত্য নয়। এখন অধ্যক্ষের পদে দায়িত্ব পালনে হাইকোর্টের রায় নিয়ে আমি স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাধা দিচ্ছেন। ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের দিয়ে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবরুদ্ধ রাখার বিষয়টি ঠিক নয়।