Logo
Logo
×

শেষ পাতা

সাইবার স্পেসে হয়রানি

ভুক্তভোগী নারীদের ৪১ ভাগই ডক্সিংয়ের শিকার

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে সাড়ে তিন বছরে ৬০৮০৮টি অভিযোগ * ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারেন না কোথায় গেলে প্রতিকার পাবেন

Icon

ইমন রহমান

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভুক্তভোগী নারীদের ৪১ ভাগই ডক্সিংয়ের শিকার

প্রতীকী ছবি

তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর অপব্যবহারও বেড়ে চলেছে। সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিনিয়ত সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই নারী। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার স্পেসে নারীরা ব্যাপক আকারে ডক্সিংয়ের (বিনা অনুমতিতে কারও তথ্য, স্পর্শকাতর ছবি প্রভৃতি প্রকাশ করা) শিকার হচ্ছেন। ভুক্তভোগী অনেক নারী আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছেন।

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের তথ্য বলছে, গত সাড়ে তিন বছরে তাদের কাছে সাইবার অপরাধের শিকার ৬০ হাজার ৮০৮ জন নারী প্রতিকার চেয়েছেন। সাইবার স্পেসে ভুক্তভোগী এসব নারীর ৪১ ভাগই ডক্সিংয়ের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ১৮ ভাগ ফেসবুক আইডি হ্যাক, ১৭ ভাগ ব্ল্যাকমেইলিং, ৯ ভাগ ইমপার্সোনেশন, ৮ ভাগ সাইবার বুলিংজনিত সমস্যা নিয়ে অভিযোগ করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী এসব নারী তাদের ডিভাইস বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডির ব্যবহারবিধি বা নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন নন। ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝতে পারেন না কী করবেন বা কোথায় গেলে প্রতিকার পাবেন। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে অভিভাবক বা পরিচিতজনকেও জানাতে চান না।

জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা যুগান্তরকে বলেন, ডক্সিং শব্দটি এসেছে ‘ডকুমেন্টস’ থেকে। এটি এমন একটি অনৈতিক প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা সংবেদনশীল তথ্য (যেমন: ঠিকানা, ফোন নম্বর, ই-মেইল, পরিবার ইত্যাদি) অনলাইনে ফাঁস বা প্রকাশ করা হয়। সাধারণত তাদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ডক্সিংকে ব্যবহার করা হয়। ডক্সিংয়ের মাধ্যমে কাউকে হুমকি দেওয়া, অপদস্থ করা বা ক্ষতি করা হতে পারে। এটি সাইবার বুলিং বা সাইবার আক্রমণের একটি অংশ। অনেক ক্ষেত্রে এটি আইনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

প্রতিকারের উপায় হিসাবে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের ডেটা প্রাইভেসি মেইনটেন করতে হবে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, নারী পুলিশ অফিসারদের সমন্বয়ে গঠিত পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এ ইউনিটের ফেসবুক পেজে ৬০ হাজার ৮০৮টি মেসেজ, হটলাইন নম্বরে ৮৬ হাজার ১৮২টি ফোনকল এবং ই-মেইলে ৯৭৭টি মেইল এসেছে। অনেকেই একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন বা একাধিকবার যোগাযোগ করেছেন। ই-মেইল ও ফোনকলে যোগাযোগ করা সেবাপ্রত্যাশীদের অনেকেই পুনরায় ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেছেন। ফলে তালিকাভুক্ত সেবাপ্রত্যাশীর সংখ্যা হলো ৬০ হাজার ৮০৮ জন। সেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ৩৯ হাজার ৩০১ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানি সংক্রান্ত বিষয়ে যোগাযোগ করেছেন। আর সর্বমোট ২৩ হাজার ৬৪৫ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ভুক্তভোগীদের একজন লতা বেগম (ছদ্মনাম, বয়স-৩২)। তিনি হঠাৎ একদিন দেখতে পান তার ফেসবুক আইডির নাম ব্যবহার করে অবিকল দুটি আইডি খোলা হয়েছে। আইডিগুলোয় তার সাধারণ ছবিগুলোকে অশ্লীল ছবির সঙ্গে যুক্ত করে পোস্ট করা হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই আইডি দুটি থেকে হয়রানির মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। ভুক্তভোগীর ছবিই শুধু না, তার আত্মীয়ের ছবির সঙ্গে ভুক্তভোগীর ছবি ও তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর যুক্ত করে আপত্তিকর ক্যাপশনসহ পোস্ট করে সামাজিকভাবে মানহানি করা শুরু করে। লতা বেগম যোগাযোগ করেন পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সঙ্গে এবং একই সঙ্গে নিকটস্থ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় অভিযুক্তদের শনাক্ত করে থানা পুলিশ। ভুক্তভোগী লতার করা পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে খায়রুজ্জামান ডালিম এবং রাসেল মোল্ল্যা নামের দুইজন ব্যক্তির নাম। খায়রুজ্জামান ছিলেন লতা বেগমের প্রতিবেশী। মূলত লতা বেগমের পরিবারের সঙ্গে খায়রুজ্জামানের জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ ছিল।

আরেক ভুক্তভোগী কলেজপডুয়া আলেয়া (ছদ্মনাম, ২২ বছর)। তারও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়। হ্যাকার আলেয়ার আইডি থেকে তার ভাইয়ের আইডিতে মেসেজ দিয়ে আইডি ফেরত নেওয়ার জন্য টাকা পাঠাতে বলে। আলেয়া নিকটস্থ থানায় জিডি করেন। আলেয়া হ্যাকারকে প্রথম পর্যায়ে টাকা পাঠালে পুনরায় টাকা চায়। টাকা না দেওয়ায় বিভিন্ন অশ্লীল ছবির সঙ্গে আলেয়ার ছবি যুক্ত করে আপত্তিকর ক্যাপশন লিখে পোস্ট করে। জিডির পরিপ্রেক্ষিতে থানা থেকে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরে প্রযুক্তিগত সহায়তায় অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়। থানা পুলিশ ভুক্তভোগীর করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এমরান নামক একজনকে গ্রেফতার করে। পরে জানা যায়, এমরান ভুক্তভোগী আলেয়ার গ্রামের বাজারের দোকানদার। আইডি হ্যাক হওয়ার এক সপ্তাহ আগে আলেয়া তার কাছে মোবাইল ফোন ঠিক করতে দেয়। সেই সময়ে আলেয়ার আইডিতে তার নিজের ই-মেইল আইডি যুক্ত করে এবং পরে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়।

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সূত্র বলছে, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীরা তাদের ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদান বা নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক নয়। পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ না থাকলে পুলিশও অনেক সময় মামলা নিতে আগ্রহী হয় না। সাইবার স্পেসে নারীদের হয়রানির বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে তথ্যানুসন্ধান করে যথাসম্ভব দ্রুত অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করে তারা। এছাড়া ভুক্তভোগীকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শও দেওয়া হয়। গুরুত্ব বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করে। এ সংক্রান্ত মামলা বা জিডির অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে তদন্তে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত সহায়তাও করে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন।

প্রতিকারের উপায় : প্রযুক্তিবিদেরা বলছেন, ডক্সিং থেকে উত্তরণের জন্য কিছু প্রতিরোধমূলক এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখা। যেমন: অনলাইনে ব্যক্তিগত তথ্য (ঠিকানা, ফোন নম্বর, জন্মতারিখ, ই-মেইল) যতটা সম্ভব গোপন রাখতে হবে এবং এমন তথ্য প্রকাশ এড়িয়ে চলতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রাইভেসি সেটিংস পরিবর্তন করা। দুই স্তরের নিরাপত্তা ব্যবহার করা। অ্যাড্রেস বা ফোন নম্বর অনলাইনে পোস্ট না করা। প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ডক্সিংয়ের শিকার হলে অনলাইনে প্রকাশিত তথ্য যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট বা প্ল্যাটফরমের সঙ্গে যোগাযোগ করা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নেওয়া।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম