কারারক্ষী বাহিনীর স্বীকৃতিসহ একগুচ্ছ দাবি
স্বরাষ্ট্রে থাকতে চায় না কারা অধিদপ্তর
জেলকোড সংস্কার, ডিউটি শিডিউল পরিবর্তন, বার্ষিক ছুটি বাড়ানো, জনবল বৃদ্ধি, সামরিক বাহিনীর মতো অস্ত্র প্রশিক্ষণ, আজীবন রেশন চালু, অস্ত্র বহনের ক্ষমতা, মেট্রোপলিটন কারাগার চালু ইত্যাদি
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকতে চায় না কারা অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত হতে আগ্রহী। রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রভাবমুক্ত থাকতেই এই দাবি উঠেছে।
কারা অধিদপ্তর কেবল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেই আলাদা হতে চায় না। তাদের আরও এক গুচ্ছ দাবি আছে। এসবের মধ্যে- জেল কোড সংস্কার, ডিউটি শিডিউল পরিবর্তন, বার্ষিক ছুটি বৃদ্ধি, আজীবন রেশন চালু, অস্ত্র বহনের ক্ষমতা, পোশাক ও র্যাংক ব্যাজ পরিবর্তন, ক্যান্টিনের লভ্যাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন, শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণ, যৌথ বাহিনীতে কাজ করার সুযোগ, স্থাপনা তৈরি ও মেরামতের কাজ নিজেদের অধীনে নেওয়া, মেট্রোপলিটন কারাগার চালু এবং কারারক্ষী বাহিনী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রভৃতি।
এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব ইতোমধ্যেই স্বারষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (কারা অধিশাখা) ড. ফারুক আহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, অধিদপ্তরের চিঠিটি এখনো শাখায় পৌঁছেনি। চিঠি পাওয়ার পর এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সূত্র জানায়, জনবল কম থাকায় কারাগারের অভ্যন্তরে ও বাইরে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা বিধান কঠিন হয়ে পড়েছে। একই কারণে স্টাফদের প্রয়োজন অনুযায়ী ছুটি দেওয়া যাচ্ছে না। এতে একদিকে স্টাফদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। দেখা দিয়েছে দায়িত্ব পালনে অনীহা। তাই দ্রুততম সময়ে প্রত্যেক কারাগারে অন্তত দ্বিগুণ কারারক্ষীর পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
পাশাপাশি কারাগারগুলোর জন্য দরকার সময়োপযোগী ও আধুনিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও প্রতিরক্ষা সামগ্রী। এসবের মধ্যে আছে অস্ত্র ও গুলি, লেগ গার্ড, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, পিপার স্প্রে, হেলমেট, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, বডি/লাগেজ স্ক্যানার, সিসি ক্যামেরা, এক্স-রে স্ক্যানার, মোবাইল জ্যামার ওয়াকিটকি কন্ট্রোল টাওয়ার প্রভৃতি।
সামরিক প্রশিক্ষণের মতো অস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কারারক্ষীদের যুগোপযোগী হিসাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে প্রস্তাবে বলা হয়েছে। বেতন বৈষম্য দূর করে অন্যান্য ইউনিফর্ম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতন গ্রেড উন্নীত করতে হবে। এছাড়া বিদ্যমান জেলকোড দিয়ে কারাগার পরিচালনায় অনেক সমস্যা হচ্ছে। কারাগারকে রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এজন্য কারাগারকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক করে জেলকোর্ড সংস্কার করা উচিত। এ ক্ষেত্রে কারা অধিদপ্তরকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা প্রয়োজন।
কারারক্ষী, সহকারী প্রধান কারারক্ষী ও প্রধান কারারক্ষীদের নিজ নিজ বিভাগে চাকরির সুযোগ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। তাদের মতে, এমন সুযোগ দেওয়া হলে তারা কারাগারে আটক বন্দিদের ভাষা ও আঞ্চলিক বন্দিদের মনোভাব সহজেই বুঝতে পারবেন। এতে বন্দি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।
পাশাপাশি সংশ্লিষ্টরা মানসিক শান্তি নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। অন্যান্য বাহিনীর মতো কারারক্ষীদের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে অন্তত ৩০ ভাগ হারে ডেপুটি জেলার পদে পদোন্নতির সুযোগ দিলে কর্মরত কারারক্ষীদের দায়িত্ব পালনে মনোবল বৃদ্ধি পাবে। কারারক্ষীদের যৌথ বাহিনীতে কাজের সুযোগ এবং শান্তিরক্ষী মিশনে যাওয়ার জন্য অন্যান্য বাহিনীর মতো একই শিক্ষাগত ও শারীরিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী নিয়োগ করা হয়। ছয় মাসের মৌলিক প্রশক্ষিণ শেষে তারা কাজে যোগ দেন। তাই কারারক্ষীদের যৌথ বাহিনীতে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে শান্তিরক্ষী মিশনের চাহিদার ভিত্তিতে কারারক্ষীদের সমন্বয়ে গঠিত প্লাটুনকে শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এতে তাদের মেধা ও দক্ষতা বুদ্ধি পাবে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কারাগারের ভেতর ও বাইরে স্থাপিত ক্যান্টিনের লভ্যাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করা হলে সংশ্লিষ্টদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে। বিষয়টি দুর্নীতির অভিযোগ লাঘবে সহায়ক হবে। বলা হয়েছে, কারারক্ষীরা একাধিক শিফটে ডিউটি করেন। তাদের ডিউটি কমিয়ে আট ঘণ্টা করলে কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া কারারক্ষীদের রোদ, বৃষ্টি ও ঝড়ের মধ্যে ডিউটি করতে হয়। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে কারা অভ্যন্তর এবং বাইরে দায়িত্বপূর্ণ স্থানে সেন্ট্রি পোস্ট স্থাপন করা একান্ত প্রয়োজন।
বর্তমানে কারারক্ষীরা বার্ষিক ছুটি পান ২০ দিন। এই ছুটি ৬০ দিনে উন্নীত করলে তারা প্রফুল্ল চিত্তে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে। কারারক্ষীদের জন্য আজীবন উন্নতমানের প্যাকেটজাত রেশন প্রদানের যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, স্টাফ মেসে ফ্রেসমানি (কাঁচাবাজারের জন্য দেওয়া টাকা) ভর্তুকির ব্যবস্থা করলে জীবনমানের উন্নতি হবে। অস্ত্র বহনের ক্ষমতার বিষয়ে বলা হয়, বন্দিদের আদালতে হাজির করা, এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে নেওয়া, হাসপাতালে স্থানান্তর এবং ফায়ারিংসহ যে কোনো কাজে কারা এলাকার বাইরে বন্দি নিয়ে গেলে পুলিশের সহায়তা লাগে। কারণ প্রচলিত নিয়মে কারারক্ষীরা অস্ত্র বহন করতে পারে না। বিষটিকে অত্যন্ত লজ্জার উল্লেখ করে বলা হয়, যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে কারা প্রশাসনকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ কারণে কারারক্ষীদের অস্ত্র বহনের ক্ষমতা প্রদান সময়ের দাবি। এ
ক কারা কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, অন্যান্য বাহিনীর মতো কারাগারের সব স্টাফের পোশাক যুগোপযোগী আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। আগের র্যাংক ব্যাজ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বিনামূল্যে পোশাক, বেডশিট, টি-শার্ট, ট্রাকস্যুট, ছাতা, টর্চলাইট, ট্রলিব্যাগ, টিফিন ক্যারিয়ার, হটপট, ক্যাডস, টাওয়েল, কম্বল এবং গ্রাউন্ড শিটসহ কিটবুকে উল্লেখিত সব জিনিসপত্র সরবরাহ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ কারাগার মূল শহরের বাইরে হওয়ায় কারাগারে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের লেখাপড়ায় অসুবিধা হচ্ছে। তাই প্রত্যেক কারাগারে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন। বন্দি পলায়ন ও বাইরে আক্রমণ রোধে দেশের সব কারাগারে জরুরি ভিত্তিতে বাউন্ডারি ও প্যারামিটার ওয়ালের উচ্চতা বাড়ানো এবং বৈদ্যুতিক বেষ্টনী স্থাপন করা দরকার। টেকনিক্যাল ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজে নিজস্ব জনবল নিয়োগের পাশাপাশি কারারক্ষীদের ইউনিফর্মধারী গাড়িচালক হিসাবে কাজের সুযোগ দিতে হবে। স্থাপনা তৈরি ও মেরামতসংক্রান্ত সব কার্যক্রম গণপূর্তের পরিবর্তে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
দেশের সব মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য মেট্রোপলিটন কারাগার চালু করা উচিত উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কারা কর্মকর্তা বলেন, স্টাফদের কল্যাণে নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। কারারক্ষীদের অবিলম্বে কারারক্ষী বাহিনী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালা অনুযায়ী দেশের সব কারাগারকে ‘১ক’ শেণিভুক্ত কেপিআই প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘোষণা দিতে হবে।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন্স) শেখ সুজাউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দাবিগুলো বেশ আগেই আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করেছিলাম। কিন্তু তৎকালীন সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছি। আশা করছি মন্ত্রণালয় যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্ট গার্ড, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং কারা অধিদপ্তর।