ডেঙ্গু রোগীর ৭০ শতাংশই ডেন-২ ধরনে আক্রান্ত
আইইডিসিআর ৫০টি নমুনা বিশ্লেষণ করে ৭০ শতাংশ ডেন-২ পেয়েছে * ডেঙ্গুতে আরও দুজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩২১
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে বিগত দুই বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ডেঙ্গুর সেরোটাইপ বা ধরন ‘ডেন-২’-এর প্রাধান্য বিস্তার করছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউিট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু পজিটিভ অর্ধশত (৫০টি) রোগীর নমুনা বিশ্লেষণ করে সেখানে ৭০ শতাংশ (৬৯ দশমিক ২০ শতাংশ) ডেন-২ এর উপস্থিতি পেয়েছে। তবে পর পর দুই বছর একই সেরোটাইপ বা ধরন প্রভাব বিস্তার করায় চলতি বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কম দেখছেন গবেষকরা।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪) চারটি ধরন রয়েছে। এবার বেশিরভাগই ডেন-২ আক্রান্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি তারা এও বলছেন যে, ডেঙ্গুর চারটি ধরনের একটিতে পজিটিভ হলে পরবর্তীতে ওই ধরনের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা তেমন নেই। তবে দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রোগীর শারীরিক অবস্থা গুরুতর হতে পারে। চলতি বছরের আগস্টের শেষ দিক থেকে শুরু হয়েছে ডেঙ্গুজ্বরের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বছরব্যাপী ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলেও গত তিন বছর ধরে প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি থাকছে আগস্ট, সেপ্টম্বর ও অক্টোবর মাসে। গত বছর (২০২৩) ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি (তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন) ও মৃত্যুর (এক হাজার ৭০৫ জন) রেকর্ড হয়েছে। ওই বছর প্রভাব বিস্তার করে ডেঙ্গুর ডেন-২ ধরন। এবারও এই ধরনটির প্রভাবের ইঙ্গিত মিলেছে আইইডিসিআরের নমুনা বিশ্লেষণে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৯ দশমিক ২০ শতাংশ ডেন-২ আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এরপর ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ ডেন-৩ শতাংশ, ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ ৪ আক্রান্ত। তবে বিশ্লেষণে ডেন-১ আক্রান্ত কোন রোগী পাওয়া যায়নি।
পর পর দুই বছর ডেঙ্গুর একই সেরোটাইপ বা ধরনে আক্রান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের সায়েন্টিফিক অফিসার (ভাইরোলজি বিভাগ) ডা. আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত ডেঙ্গুর একটি সেরোটাইপের প্রাধান্য থাকে তিন থেকে চার বছর। এ সময় বড় একটি সংখ্যক মানুষ এই সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের মধ্যে ইমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি) হয়। গত বছরও সেরোপটাইপ-২ এর প্রাধান্য দেখা গেছে। যেহেতু এবার সেরোটাইপ (ডেন-২) রয়েছে, সুতরাং আগের সেরোটাইপটার জন্য মানুষের মধ্যে ইমিউনিটি আছে। সে হিসাবে বলা যায় ডেন-২ আক্রান্ত করতে পারবে এমন সুযোগ কম। তবে ঢাকার বাইরে বড় একটি সংখ্যক মানুষ যারা ডেন-২ আক্রান্ত হয়নি। তাদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে।
ডা. আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ আরও বলেন, ২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেন-২ বা সেরোটাইপ-২ এর প্রাধান্য ছিল। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছিল সেরোটাইপ-৩। এরপর ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালে সেরোটাইপ-২ প্রভাব বিস্তার করছে।
গত দুই সপ্তাহে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে প্রায় দুইগুণ। ভর্তি রোগীদের বড় একটি অংশ ঢাকার বাইরে থেকে চিকিৎসা নিতে আসছে। সেবাদাতা চিকিৎসকদের মতে ঢাকার বাইরের রোগীদের বেশিরভাগই শক সিনড্রোম নিয়ে আসছে। যাদের বেশিরভাগই প্রথবার ডেঙ্গু আক্রান্ত। স্যাম্পল বিশ্লেষণ করলেও হয়তো দেখা যাবে ডেঙ্গুর ডেন-২ ধরনে আক্রান্ত।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু সেরে যায়। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই জটিল পরিস্থিতিগুলো হলো ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।
অন্যদিকে হেমারেজিক ডেঙ্গুতে রোগীর চোখে রক্ত জমে যায়। নাক, দাঁতের মাঢ়ি থেকে রক্ত ঝরে; মুখ, কান, মলদ্বার এরকম যেকোনো একটি বা একের অধিক অংশ দিয়ে রক্ত বের হতে পারে। বমি ও কাশির সঙ্গেও রক্ত বের হতে পারে।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. এসএম হাসিবুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শক সিনড্রোম ও হেমোরজিক ফিবার দুই ধরনের সমস্যা নিয়ে রোগী আসছে। গত বছর শক সিনড্রোমের রোগী আরও বেশি ছিল। কারও মধ্যে শক সিনড্রোম বা হেমোরজিকের উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
ডেঙ্গুতে আরও দুজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩২১ : এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার সকাল থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে এবং একই সময়ে সারা দেশে ৩২১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ছয় জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬৫ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৮৮ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭৮ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২২ জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২৮ জন রয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ১৪৩ জন।