যুগান্তরকে সাইফুল হক
যে ক্ষমতার সময়সীমা নেই তা সব সময়ই বিপজ্জনক
শেখ মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষনেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, বর্তমান সরকার একেবারেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার পর্যন্ত এ সরকার দায়িত্ব পালন করবে। সেটাও বিরোধী দলগুলোর সম্মতি সাপেক্ষে। তিনি আরও বলেন, যে ক্ষমতার কোনো লাগাম নেই, সময়সীমা নেই, কোনো বেড় নেই, চৌহদ্দি নেই-সেই ক্ষমতা সবসময়ই বিপজ্জনক। যে কোনো সময় এটা বিপজ্জনক পথে ধাবিত হতে পারে। কারণ, তাদের জবাবদিহির কোনো বিষয় নেই। আর একটা জবাবদিহিহীন অনির্দিষ্টকালীন কোনো সরকারকে নিশ্চয়ই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য দেশ, বিরোধী দল, জনগণ-আমরা দায়িত্ব দিইনি।
সম্প্রতি যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সাইফুল হক এসব কথা বলেন। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির তোপখানায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আওয়ামী লীগ আমলের অনিয়ম, দুর্নীতি, দলীয়করণ, দুর্নীতিবাজদের বিচারের দাবি জানানোসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। এছাড়াও ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে তার ভাবনার বিষয়গুলোও অকপটে তুলে ধরেন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা-আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা, সংবিধান সংশোধন, রাষ্ট্র সংস্কার, জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনি জোট গঠনসহ নানা বিষয় উঠে আসে সাইফুল হকের বক্তব্যে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে বামপন্থি এ রাজনীতিক নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, আমরা একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাই। এ যৌক্তিক সময়টা তিন-ছয় মাস, না এক বছর হবে; তা অনতিবিলম্বে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অর্থপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে কী ধরনের পরিবেশ থাকা দরকার, সেই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলার সঙ্গে বোঝাপড়া দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সঠিক পথে হাঁটতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে বোঝাপড়ায় সমস্যা হবে না। তবে এটাও ঠিক, অনিশ্চিত অনির্ধারিত সময়ের জন্য নির্বাচন ঝুলিয়ে রাখার কৌশল রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করবে না।
সংবিধান সংশোধন সম্পর্কে সাইফুল হক বলেন, এ বিষয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে। বিদ্যমান সংবিধান অগণতান্ত্রিক। ৭০ অনুচ্ছেদসহ সাম্প্রদায়িক স্ববিরোধী অনেক ধারা সংবিধানে আছে, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিষয়েও প্রশ্ন আছে-এগুলো সংশোধন বা সংযোজন প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-কাজটি করবে কারা। আমি মনে করি, এগুলো তারাই করবে, যাদের জনগণ সমর্থন করে, যাদের বৈধতা আছে, রাজনৈতিক ম্যান্ডেট আছে। আমি মনে করি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মানুষ যাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করবে, বৈধ ম্যান্ডেট দেবে-তাদেরই বৈধ এখতিয়ার সংবিধান সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, এমনকি কোনো ধারা পুনর্লিখনেরও যদি দরকার হয়-সে কাজটা করবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সত্যিকারের প্রতিনিধিরা। আমরা দেখছি, কেউ কেউ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উসকানি দিচ্ছেন, বলতে চাইছেন-তারা নতুন সংবিধান করবেন, পুরো সংবিধান পুনর্লিখন করবেন। এখানে আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার-নতুন সংবিধান তৈরি বা সংবিধান সংশোধন-সংযোজন কিংবা পুনর্লিখনের কোনো রাজনৈতিক অথরিটি, এমনকি মোরাল অথরিটিও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। বিষয়টি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার তথা সংসদের হাতেই রাখা দরকার।
সাইফুল হক বলেন, ফ্যাসিজমের পতন ঘটলেও বাস্তবে দেখবেন বিদায়ি সরকারের পুরো স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো কিন্তু অক্ষুণ্ন আছে। ওপর থেকে নিচ-সর্বত্র একই ব্যবস্থা বিদ্যমান। কেবল কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। এজন্য দরকার সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা; নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ভুলেই গেছে যে নির্বাচন কী। ১৬ বছর ধরে তারা ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটা মাথায় রেখে সামনে পা ফেলতে হবে।
রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন, সবাই এখন সংস্কারের কথা বলছেন। সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে সংস্কারের দাবি উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কার কী এজেন্ডা আছে, কার কী প্রস্তাবনা আছে-এগুলো নিয়ে আলোচনায় বসা। অন্তর্বর্তী সরকার এখানে মডারেটরের ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা সংস্কারের বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি তালিকা নির্ধারণ করতে পারে-কোন কাজগুলো তারা করবেন, কী কী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কার দরকার, তা তারা ঠিক করবেন। এ কাজের জন্য অবশ্যই একটি সময়সীমা থাকতে হবে।
রাজনৈতিক এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর প্রথম করণীয় ঠিক করা সম্পর্কে তিনি বলেন, এবারকার এ ছাত্র-শ্রমিক-জনতা, তাদের যে গণজাগরণ ও গণঅভ্যুত্থান-এখানে তো মানুষের বিশাল একটি প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হয়েছে। সেই প্রত্যাশা হচ্ছে-দেশটা আগের ধারায় যাতে না চলে। সরকার, রাষ্ট্র, প্রশাসন, সংবিধানসহ প্রায় সব পর্যায়ে অনেক পরিবর্তন দরকার। সংস্কার দরকার। আমরা মনে করি, অভ্যুত্থানের পরপরই দেশে আধা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। খুব দ্রুত এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা আছে, সেটা জরুরিভাবে সমাধান করা দরকার। পুলিশের অধিকাংশ সদস্য এখন পর্যন্ত কার্যকর ভূমিকায় নেই। পুলিশ প্যাট্রোলে নেই, তারা তদন্তে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে এবং সাহস নেই। সবার আগে উচিত হবে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা জোরদার করা, পুলিশকে সক্রিয় করা। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে-অর্থনৈতিক ইস্যুতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু সাফল্য আছে। প্রথমদিকে দ্রব্যমূল্য কিছুটা কমলেও আবার তা লাগামহীনভাবে বাড়ছে। কিছুদিন যেহেতু মধ্যস্বত্বভোগীরা বাইরে ছিল, এখন আবার তারা সরব। যে কারণে দাম বাড়ছে। এ সিন্ডিকেটগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। যদিও আমরা সবাই জানি সিন্ডিকেট কারা, তাদের বিরুদ্ধে একটি ক্ষমাহীন ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাইফুল হক বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা পুরোপুরি ধসে পড়েছে। এ ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার করে একটি গ্রহণযোগ্য, চৌকশ, অভিজ্ঞতা আছে, দূরদর্শিতা আছে এবং ক্ষমতা আছে-এমন একটি কমিশন গঠন করতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাইরে নির্বাচন কমিশন যাতে ভূমিকা পালন করতে পারে, তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এর বাইরে ১৬ বছর ধরে গণহত্যার পাশাপাশি চুরি-ডাকাতি, জবরদখল, খুন-গুম-অপহরণ-অর্থ পাচার-ঋণখেলাপি, লুটেরাসহ বিভিন্ন অপরাধে যারা যুক্ত-তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা দেখছি ফুটপাত থেকে শুরু করে ওপরের নানান পর্যায়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সবকিছুতে একধরনের জবরদখল চলছে। পালটা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আবার শুরু হয়েছে। দেশের মানুষ এগুলো দেখতে চায় না। আগে যা হয়েছে, তা যদি এখনো চলতে থাকে, তাহলে মানুষ আশাহত হবে। ইতোমধ্যে এ দখলদারির বিরুদ্ধে একধরনের জনমত গড়ে উঠছে। আমরা মনে করি, অবিলম্বে এগুলো বন্ধে কঠোর বার্তা দেওয়া দরকার। জবরদখলের সংস্কৃতি চলতে থাকলে এটাও আরেক ধরনের মগের মুল্লুকের জায়গা হবে।