বায়ুদূষণ রোধ: জনস্বার্থে করা মামলার রায় কার্যকর হচ্ছে না
আলমগীর মিয়া
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়ে ২০২০ সালে রায় দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা ছিল-ঢাকার সড়কগুলোতে পানি ছিটানো, যেসব গাড়ি কালো ধোঁয়া ছাড়ে সেগুলো জব্দ করা, যেসব ইটভাটা লাইসেন্সবিহীনভাবে চলছে, সেগুলো বন্ধ করা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেই নির্দেশনার এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
জনস্বার্থে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। জানতে চাইলে যুগান্তরকে তিনি বলেন, আদালতের ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন চেয়ে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম। সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশনসহ সব পক্ষের কাছে জানতে চেয়েছেন। বায়ুদূষণ রোধে তারা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু সেই নির্দেশনার পুরোপুরি বাস্তবায়ন এখনও হয়নি।
মনজিল মোরসেদ মানবাধিকার সংগঠন এইচআরপিবি-এর চেয়ারম্যান। এ পর্যন্ত তিনি জনস্বার্থে মামলা করেছেন চারশ’র বেশি। এর মধ্যে একশ’র বেশি মামলায় চূড়ান্ত রায় পেয়েছেন। রায় বাস্তবায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, জনস্বার্থে মামলার কারণে অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। রায় বাস্তবায়ন এখনো চলমান। অবৈধ ইটভাটা বন্ধ বা উচ্ছেদ নিয়ে উচ্চ আদালত কয়েক দফা নির্দেশনা দেন। কিন্তু আদেশ বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের তৎপরতা সন্তোষজনক নয়। অবৈধ ইটভাটা এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
বায়ুদূষণ রোধে ৯ দফা নির্দেশনা : ১. ঢাকা শহরের মধ্যে বালি বা মাটি বহনকারী ট্রাকগুলোকে ঢেকে পরিবহণ করতে হবে। ২. যেসব জায়গায় নির্মাণ কাজ চলছে সেসব জায়গার কনট্রাকটররা তা ঢেকে রাখবে। ৩. এছাড়া ঢাকার সড়কগুলোতে পানি ছিটানোর যে নির্দেশ ছিল, সেই নির্দেশ অনুযায়ী যেসব জায়গায় এখনো পানি ছিটানো হচ্ছে না, সেখানে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. সড়কের মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজ এবং কার্পেটিংয়ের যেসব কাজ চলছে, যেসব কাজ যেন আইন-কানুন এবং চুক্তির শর্তাবলী মেনে করা হয়, সেটা নিশ্চিত করার নির্দেশ। ৫. যেসব গাড়ি কালো ধোঁয়া ছাড়ে সেগুলো জব্দ করতে বলা হয়েছে। ৬. সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করতে হবে এবং যেসব গাড়ি পুরাতন হয়ে গেছে সেগুলোর চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের নির্দেশ। ৭. যেসব ইটভাটা লাইসেন্সবিহীনভাবে চলছে, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনো বন্ধ করা হয়নি, সেগুলো বন্ধ করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ। ৮. পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া টায়ার পোড়ানো এবং ব্যাটারি রিসাইক্লিং বন্ধের নির্দেশ। ৯. মার্কেট এবং দোকানের বর্জ্য প্যাকেট করে রাখতে এবং তা মার্কেট ও দোকান বন্ধের পর সিটি করপোরেশনকে ওই বর্জ্য অপসারণ করার নির্দেশ।
অবৈধ ইটভাটা বন্ধ বা উচ্ছেদের নির্দেশনা চেয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে হাইকোর্টে ২০১৯ সালে রিট করা হয়। এর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। আদেশে অবৈধ সব ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং ইটভাটায় জ্বালানি হিসাবে কাঠের ব্যবহার বন্ধ নিশ্চিত করতে ডিসিদের নির্দেশনা দিতে বলা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের প্রতি এ নির্দেশ দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কিন্তু এ নির্দেশনা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
এমন অসংখ্য জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগ যুগান্তকারী নির্দেশনা বা রায় দিলেও তা বাস্তবায়নের হার খুবই কম। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ ও সাধারণ মানুষ। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিনিয়তই উদাসীনতা, নিষ্ক্রিয়তা, অবহেলার পরিচয় দিচ্ছে-এমন মন্তব্য আইন বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, এ অবস্থায় রায়গুলো বাস্তবায়নে মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট প্রভাবশালীদের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ আদালতের নির্দেশনা তামিল করা সম্ভব হয় না। জনস্বার্থে করা মামলার স্বীকৃত কোনো পরিসংখ্যান নেই। পরিসংখ্যান প্রস্তুত করারও পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, এইচআরপিবি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), চিলড্রেন চ্যারিটি ফাউন্ডেশন ছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু সংগঠন এ ধরনের মামলা করছে।
মনজিল মোরসেদের যুগান্তকারী রিটগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তায় অবৈধ দখল বন্ধ করে বিচারক ও আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থী মানুষের যাতায়াত সহজ করা, পাহাড় কাটা, জলাশয় ভরাট রোধ, সুচিত্রা সেনের বাড়ি উদ্ধার, বেগম রোকেয়ার বাড়ি থেকে গার্মেন্ট অপসারণ, কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত অবৈধ দখলমুক্ত করা, নদী-খাল উদ্ধার, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষা, বুড়িগঙ্গাসহ দেশের বৃহত্তর চার নদী রক্ষা, লালবাগ কেল্লাসহ ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা সংরক্ষণ, অবৈধ ইটভাটা ধ্বংস ও অর্থ পাচারকারীদের তালিকা চেয়ে নির্দেশনা এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিপন্ন চার নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা রক্ষায় সীমানা চিহ্নিত করে পিলার স্থাপন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, নদী খনন ও পলি অপসারণ এবং নদীর তীরে গাছ লাগানোর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০০৯ সালে ওই রায়ের পর এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। শব্দদূষণ রোধে করা এক রিটের রায়ে সারা দেশে গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। যানজট ও ধুলাবালির এই ঢাকা শহরে গৃহস্থালির বর্জ্য অপসারণ ও পরিবহণের সময় পথচারীরা দুর্ভোগে পড়ে। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৮ সালে নির্দেশনা দেন। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তা এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ঢাকার চারপাশের নদীর রক্ষণাবেক্ষণ, মহাস্থানগড় সংরক্ষণ, শহিদ মিনারের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, সরকারি হাসপাতালের রোগীদের কাছ থেকে ভ্যাট ও ইউজার ফি আদায় বন্ধ, পিপার স্প্রে নিষিদ্ধসহ অন্তত ৪শ’ জনগুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় কৃষিজমি দখল ও পরিবেশ দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন আদালত।
সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, আইন না মানার এক ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে আমাদের মধ্যে। সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা প্রতিপালন না করাকে আদালত অবমাননা বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সংবিধান নাগরিকদের যে অধিকার দিয়েছে, তা রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রতিপালিত না হওয়ায় জনস্বার্থে মামলা করা হয় সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মানতে বাধ্য করার জন্য। তিনি বলেন, আদালতের রায় অবশ্যই প্রতিপালন করা উচিত।