বিশৃঙ্খল নগরসেবা সংস্থা সেবাবঞ্চিত গ্রাহকরা
ফ্যাসিস্টদের দোসর দুর্নীতিবাজরা এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল * কঠোর কর্মসূচি দিতে যাচ্ছেন বঞ্চিতরা
মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে রাজধানীর নগরসেবা সংস্থাগুলোয় রীতিমতো বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দুর্নীতিগ্রস্ত দোসররা আছেন দিব্যি বহাল তবিয়তে। নানাভাবে বৈষম্যের শিকার বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ওইসব পদে আর দেখতে চাচ্ছেন না। এসব নিয়ে নগর সংস্থার প্রশাসনে অস্থিরতা চলায় গ্রাহকরা সেবা পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, ৫ আগস্টের পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রকে অপসারণ করেছে সরকার। তাদের জায়গায় সরকার প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ায় সিংহভাগ পলাতক রয়েছেন। এতে করে ওয়ার্ড পর্যায়ের মশক নিয়ন্ত্রণ, আবর্জনা পরিষ্কার ও উন্নয়ন কাজ তদারকি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ পদে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও দলবাজ কর্মকর্তারা বহাল থাকায় অন্যদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে সেবা ও উন্নয়ন কাজে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে ঢাকা ওয়াসায়ও। সেখানে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বহুল আলোচিত দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী তাকসিমের দোসররা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি তাদের দখলে। বঞ্চিত ও অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত হওয়াদেরও স্বপদে বহাল করা হচ্ছে না। এসব নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। এতে করে পানি ও পয়ঃসেবার উন্নয়ন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেও (রাজউক)। সরকার পতনের পর থেকে কার্যত রাজউকের সার্বিক কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে। স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল রাজউকে ঢুকে অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে।
আরও জানা গেছে, বিগত সময়ে বিভিন্ন প্রকল্প ও বড় বড় পদে থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে অনেকে জার্সি বদলের অপচেষ্টা করছে। বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব মানতে নারাজ। এই অবস্থায় রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বলাচলে ভেঙে পড়েছে। অন্যান্যও সেবা নেই বললেই চলে। সবার মাঝে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্রে জানা যায়, সংস্থার মেয়রকে বরখাস্ত করার পর সেখানে একজন প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার। তিনি সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব। তবে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় বৃহস্পতিবার তিনি ডিএসসিসিতে শেষ অফিস করেছেন। রোববার পর্যন্ত কাউকে নতুন প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এছাড়া সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতা অপব্যহারেরও অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তার অন্যত্র বদলি হলেও তিনি ডিএসসিসি ছেড়ে যাচ্ছেন না। এসব কারণে সংক্ষুব্ধ কর্মচারীরা রোববার তাকে দপ্তরে আটকে রাখেন। বিক্ষোভ করেন এবং তাকে ডিএসসিসি ছেড়ে যেতে চাপ প্রয়োগ করেন। এসব ঘটনায় ডিএসসিসিতে মারাত্মক অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর প্রভাব পড়েছে সেবা ও উন্নয়ন কাজে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সূত্রে জানা যায়, বিগত সরকারের সময়ে প্রেষণে আসা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এসব নিয়ে সংক্ষুব্ধ শ্রমিক কর্মচারীরা। তাদের অভিযোগ, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও প্রেষণে নিয়োজিত আমলারা এখনো দাপট দেখাচ্ছেন। তারা এখনো দুর্নীতিবাজ ও আওয়ামী লীগের দোসরদের সহযোগিতা করে চলেছেন। এসব দলবাজ ও দুর্নীতিবাজদের হটাতে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে শিগগির মাঠে নামবেন বঞ্চিতরা।
ডিএনসিসির সংক্ষুব্ধ কর্মচারীদের নেতৃত্ব দেওয়া ছিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে জানান, বর্তমান প্রশাসককে আমরা সুন্দরভাবে বলেছি। তারা বঞ্চিতদের অধিকার ফিরিয়ে দিচ্ছে না। দুর্নীতিবাজদের নানাভাবে সুবিধাজনক পদায়ন করে রেখেছেন। প্রেষণে আসা দুর্নীতিবাজদের ফেরত পাঠাচ্ছে না। অন্যান্য সংস্থায় নানা বিশৃঙ্খলা হলেও ডিএসসিসিতে আমরা কোনো বিশৃঙ্খলা হতে দেইনি। এখন আমাদের বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, ডিএনসিসিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিভিন্ন অসন্তোষ রয়েছে, এটি সঠিক। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলে যৌক্তিক সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি।
আর সেবা কার্যক্রমও যাতে ব্যাহত না হয়, সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি। তবে অনেক কাউন্সিলর পলাতক থাকায় মাঠপর্যায়ের তদারকি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেটাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
ঢাকা ওয়াসার নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর ২ দিন অফিস করেছি। সবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সমস্যাগুলো শুনছি। গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কোনো প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সেবা কার্যক্রম বিষয়ে জানতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে রাজউকে এক রকম স্থবিরতা বিরাজ করছে। তবে আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সেবা কার্যক্রমের বিষয়ে এবং কর্মচারীদের বিশৃঙ্খলার বিষয়ে জানতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, পট পরিবর্তনের পর ডিএসসিসির সেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। সেখান থেকে সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে রোববার থেকে প্রশাসক নেই। তবে সবকিছু এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।