শামীম হত্যায় জাবি শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া
অপরাধী প্রত্যেককে শাস্তির আওতায় আনতে হবে
ধামরাই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গ্রেফতার
জাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) গণপিটুনিতে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম মোল্লা নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে থাকলেও কেউ কেউ এ দাবির সঙ্গে একমত নন। শামীমের নির্মম মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে শিক্ষকরা বলেছেন, অপরাধী যে দলেরই হোক সেটা বিবেচ্য নয়, প্রত্যেককেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ১৮ সেপ্টেম্বর শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেটসংলগ্ন এলাকায় এলে শিক্ষার্থীরা তাকে প্রাথমিকভাবে গণপিটুনি দিয়ে নিরাপত্তা শাখায় হস্তান্তর করেন। পরে নিরাপত্তা শাখায় তালাবদ্ধ শামীমকে তালা ভেঙে বেধড়ক মারধর করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। পরে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হামলায় অভিযুক্ত ৮ শিক্ষার্থীকে বৃহস্পতিবার সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এদের অধিকাংশই ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এ প্রেক্ষিতে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে অবিলম্বে জাকসু চালুর দাবি করেন তারা।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর অধ্যাপক মোতাহের হোসেন বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তা খুবই নিন্দনীয়, যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করবে প্রশাসন।’ নিরাপত্তা শাখায় তালাবদ্ধ অবস্থায় হামলা এবং বেধড়ক মারধরে প্রশাসনের ভূমিকার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সবকিছু এত দ্রুত ঘটেছে যে প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কিন্তু তবুও যত দ্রুত সম্ভব তাকে উদ্ধার করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে প্রশাসন।’ হামলায় ছাত্রদলের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যারা হামলাকারী তারা সন্ত্রাসী, তাদেরকে আমরা সন্ত্রাসী হিসাবেই দেখছি, কে কোন দলের এটা আমাদের বিবেচ্য নয়, যারাই অপরাধ করেছে প্রত্যেককে শাস্তির আওতায় আনবে প্রশাসন।’ দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন নিরাপত্তা শাখার ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘নিরাপত্তা শাখার প্রটোকলে থাকা অবস্থায় এমন হত্যাকাণ্ড অবশ্যই নিন্দনীয় ও সন্দেহজনক। প্রশাসনের উচিত ছিল তার যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রশাসনের নিরাপত্তায় থাকা অবস্থায় এ হত্যাকাণ্ডের দায় প্রশাসন কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। যারা হামলা করেছে তারা বেশিরভাগই ছাত্রদলের এবং সাবেক শিক্ষার্থী। যাদের ছাত্রত্বই নেই তাদের সাময়িক বহিষ্কার করা প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। তারা কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার অধিকার রাখে না, কোনো সাবেক শিক্ষার্থী যেন হলে থাকতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা দাবি তুলব।’
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যারা এতদিন ধরে কোনো অপকর্ম ছাড়াই রাজনীতি করে আসছে, তারা কেন ছাত্রলীগ বা অন্যান্য অপকর্মকারীদের দায় নেবে? এ ধরনের অপরাধ যেন আর সংঘটিত না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করার পক্ষে আমি নই। এছাড়াও যেসব শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলছে তারাও তো একটি দলের অংশ, তাদেরও কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। তারা চায় শুধু তারাই রাজনীতি করবে অন্যরা নিষিদ্ধ হবে, এটা তো ন্যায্য দাবি হতে পারে না। সব ছাত্রের রাজনৈতিক অধিকার থাকতে হবে।’
ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এটিএম আতিকুর রহমান বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত এমন হত্যাকাণ্ড অবশ্যই নিন্দনীয়। প্রশাসন ইতোমধ্যে অভিযুক্তদের তালিকা ও সাময়িক বহিষ্কার করেছে এবং সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করবে। প্রশাসনের উচিত ভবিষ্যতে যেন এমন কর্মকাণ্ড না ঘটে সেটার ব্যবস্থা করা।
গণপিটুনিতে নিহত শামীম মোল্লা ১৫ জুলাই ভিসির বাসভবনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিল।
রাজনীতি নিষিদ্ধসহ তিন দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : জাবি ক্যাম্পাসে সব ধরনের দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজনীতি নিষিদ্ধসহ তিন দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিভিন্ন হল থেকে তারা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে জড়ো হন। এরপর বেলা ৩টায় শহিদ মিনার থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে তারা অবস্থান নেন। মিছিলে তারা ‘ডান-বামের রাজনীতি, চাই না কারও উপস্থিতি’; ‘রাজনীতির কালো হাত, এই জাবিতে নিপাত যাক’; ‘সব জাবিয়ান ভাই ভাই, রাজনীতির ঠাঁই নাই’; ‘রাজনীতির অংশীদার, এই মুহূর্তে জাবি ছাড়’; ‘একদফা এক দাবি, চাই না কোনো রাজনীতি’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। এ সময় তারা উপাচার্যের কাছে তিনটি দাবি পেশ করেন এবং আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাবিগুলো বাস্তবায়নের আলটিমেটাম দেন। দাবির মধ্যে রয়েছে-সব ধরনের দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র-শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে জাবি ছাত্র সংসদ জাকসু নির্বাচন দিতে হবে। ১৪ থেকে ১৭ জুলাই ক্যাম্পাসে হামলাকারী ও মদতদাতা সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘হঠাৎ করে আন্দোলনের মুখে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা মব জাস্টিসের মতোই এবং বিরাজনীতিকরণেরই নামান্তর। তাই অংশীজন সবার মতামতের ভিত্তিতে এটা নিষিদ্ধ করতে হবে। এ জন্য প্রশাসনকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।’
ধামরাই কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গ্রেফতার : ধামরাই (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় ধামরাই সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান খান হাবিবকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতে আশুলিয়া ও ধামরাই থানা পুলিশের যৌথ অভিযানে ধামরাই পৌর শহরের মোকামতলা মহল্লার নিজের বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করে। তিনি আশুলিয়া থানা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন এবং তাকে শামীম হত্যার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুবকর সিদ্দিক। এর আগে শামীম হত্যার ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার-১ (নিরাপত্তা) সুদীপ্ত শাহিন বাদী হয়ে ৮ জনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন।