Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বকেয়া ৮ কোটি মার্কিন ডলার

বাংলাদেশকে সার দিচ্ছে না সরবরাহকারীরা

বকেয়া বিলের অর্থ চেয়ে চার দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে চাপ * সংকট থেকে উত্তরণে অর্থ উপদেষ্টাকে কৃষি উপদেষ্টার জরুরি ডিও

Icon

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশকে সার দিচ্ছে না সরবরাহকারীরা

সার

ডলার সংকটের কারণে গত জুন থেকে এলসি বন্ধ থাকায় বাংলাদেশকে সার সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮ কোটি মার্কিন ডলার বকেয়া পড়েছে। এ কারণে চীন, কানাডা, সৌদি আরব ও মরক্কো-এ চার দেশের রপ্তানিকারকরা বাংলাদেশকে সার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি বকেয়া বিলের অর্থ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে চাপ প্রয়োগ করছে তারা।

কৃষি অর্থনীতির মূল শক্তি সার। সেই সার যখন দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় এবং বকেয়া না পেয়ে তা সরবরাহ বন্ধের কথা বলা হয়, তখন তা শঙ্কার। কৃষির জন্য আতঙ্কের। বিষয়টি চলতি বছরের জুন থেকে গড়ালেও ডলার সংকটের কারণে বিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকার কৃষির স্বার্থে তড়িঘড়ি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানা গেছে। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এখন সেই চাপও নিতে হচ্ছে। কারণ, সার আমদানির বিষয়ে সরবরাহকারীদের পাওনা শোধে দেরি হলে এর প্রভাব পড়বে কৃষির ওপর। এমন বাস্তবতায় চার দেশের সার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ করার বিষয়ে জোর দিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতি তুলে ধরে দ্রুত ডলার সংকট সমাধানের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে আধা সরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছেন কৃষি উপদেষ্টা। সম্প্রতি তিনি এ পত্র দেন। এর আগেও সার আমদানিতে ডলার সংকটের কথা অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছিল। তবে কাজ হয়নি। অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আমরা আশা করছি, সার আমদানির ক্ষেত্রে ডলার সংকট থাকবে না। বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

বিএডিসির কাছে ৮০ মিলিয়ন বা ৮ কোটি মার্কিন ডলার পাওনা বিদেশি সার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। তাদের পাওনা পরিশোধে একদিকে যেমন দেরি হচ্ছে এবং সার আমদানি নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে, তেমনই এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারিভাবে সার আমদানিতেও ভাটা পড়েছে বলে জানা গেছে। ব্যাংক খাতের বিদ্যমান অস্থিরতার কারণে সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বানের পরও সায় মিলছে না বেসরকারি পর্যায় থেকে। ঠিক এ সময়টায় দেশে সারের মজুতও ফুরিয়ে আসছে। চাহিদার তুলনায় মাত্র তিন মাস (ডিসেম্বর পর্যন্ত) চলবে বর্তমান মজুত দিয়ে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের ডিওতে বলা হয়, ডলার সংকটের কারণে গত জুনেই বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সার আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা স্থগিত করেছে সোনালী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে সোনালী ব্যাংকের বিকল্প হিসাবে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকটি শতভাগ মার্জিন ছাড়া এলসি খুলবে না মর্মে জানিয়ে দিয়েছে বিএডিসিকে।

জানতে চাইলে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান মঙ্গলবার যুগান্তরকে জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বকেয়া পরিশোধের পর এখন আমাদের কাছে আন্তর্জাতিক সার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনার পরিমাণ ৫ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থসচিবের সঙ্গে আজও (মঙ্গলবার) কথা হয়েছে। এখন মরক্কো ও সৌদি আরবের বকেয়া দিতে পারলে আশা করি, সার আমদানির কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে। তখন দুই থেকে চার দিন পরপর ডলার পেলেও তেমন সমস্যা হবে না। তবে এ মুহূর্তে আমাদের ৫৫ মিলিয়ন ডলার দরকার।

অর্থ উপদেষ্টার কাছে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, দেশে যে সারের মজুত আছে, নভেম্বর পর্যন্ত সমস্যা হবে না। কিন্তু বিদেশ থেকে সার আমদানির লিড টাইম ৯০-১২০ দিন। অর্থাৎ আজ আমদানির এলসি খোলা হলেও তিন মাস সময় লাগবে দেশে পৌঁছাতে। ফলে এ মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে সার আমদানি প্রয়োজন। আর সেটি শুরু করা না গেলে আগামী ডিসেম্বর থেকেই সংকটজনিত নানা সমস্যা দেখা দেবে-এমন আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করা হয়।

এদিকে অক্টোবরে শুরু হচ্ছে রবি মৌসুম। যেখানে ৪০ লাখ মেট্রিক টন সারের প্রয়োজন দাঁড়াবে। এ মুহূর্তে দেশে ইউরিয়া সারের মজুত আছে ৫ লাখ ৭০ হাজার টন। কিন্তু মোট চাহিদা ২৭ লাখ মেট্রিক টন। অপরদিকে টিএসপি সারের মজুতের পরিমাণ ৩ লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন, চাহিদা ৭ লাখ ৫০ হাজার টন। এছাড়া ডিএপি সারের ১৫ লাখ টনের চাহিদার মধ্যে মজুত আছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন এবং সাড়ে ৯ লাখ মেট্রিক টন এমওপি সারের চাহিদার বিপরীতে মজুত ৪ লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরিয়া সারের আমদানি ব্যাহত হলে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটবে, যা দেশের কৃষিপণ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। খাদ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিতভাবে হুমকির মুখে ফেলবে।

সূত্রমতে, বিভিন্ন দেশ থেকে সার আমদানির পর নির্ধারিত সময়ে অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি বিএডিসি। এর কারণ, দেশে ডলারের সংকট। ফলে এখন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিএডিসির কাছে সারের মূল্য বাবদ মোটা অঙ্কের বকেয়া পড়েছে।

এদিকে ২০০৮ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় চুক্তির আওতায় বিভিন্ন দেশের সরকারি সংস্থা থেকে সার আমদানি করছে বিএডিসি। এক্ষেত্রে সরকারি গ্যারান্টি নিয়ে এলসি খুলে আসছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত নন-ইউরিয়া সার আমদানির এলসি খুলে আসছে ব্যাংকটি। কিন্তু ডলার সংকট দেখিয়ে গত জুন থেকে এলসি খোলা স্থগিত করে দেয় সোনালী ব্যাংক। এতে সার আমদানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়।

সূত্র জানায়, সার আমদানির এলসি খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে সোনালী ব্যাংকের বিকল্প হিসাবে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তাব বিএডিসির পক্ষ থেকে পাঠানো হয়। কিন্তু শতভাগ মার্জিন ছাড়া এলসি খুলতে অপারগতা জানায় ব্যাংকটি। আর নিজস্ব কোনো মূলধন না থাকায় বিএডিসির সার আমদানিতেও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এরপর দেশে শুরু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই পরিস্থিতিতে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিকারকরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও তাতে সায় পায়নি বিএডিসি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি এক সার আমদানিকারক জানান, ব্যাংক খাতে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। অনেক ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। আবার কোথাও ব্যাংক দখল ও পালটা দখল হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি আমদানিকারকরা সার আমদানিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

এদিকে গ্যাস সংকটে অধিকাংশ ইউরিয়া সার কারখানা বন্ধ থাকায় সারের এই সংকট আরও জটিল রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) আওতাভুক্ত পাঁচটি সার কারখানার মধ্যে গ্যাস সংকটে চারটিই এখন বন্ধ। একমাত্র চালু আছে ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানা; নতুন কারখানাটির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৯ লাখ ২৪ হাজার টন। সে তুলনায় দেশের ইউরিয়ার চাহিদা বছরে ২৭ লাখ টন। ফলে সার সংকট বছরজুড়েই লেগে থাকে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম