Logo
Logo
×

শেষ পাতা

জনপ্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা

সচিব নেই গুরুত্বপূর্ণ সাত মন্ত্রণালয় ও বিভাগে

সুবিধাভোগীরাও বঞ্চিত দাবি করে আবেদন করেছেন

Icon

আমিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সচিব নেই গুরুত্বপূর্ণ সাত মন্ত্রণালয় ও বিভাগে

জনপ্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে বিগত সরকারের সময় দেওয়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হচ্ছে, অপরদিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অব্যাহত রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সাতটি মন্ত্রণালয়ে সচিব নেই। উচ্চ পদগুলোতে পদায়নের জন্য নিয়োগ বিধির শর্ত শিথিলের প্রস্তাব করা হলে তা অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

তাছাড়া জনপ্রশাসনে সার্বক্ষণিক উপদেষ্টা না থাকায় সব ক্যাডারের সমস্যা ও দাবির চাপ এসে পড়ছে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে। ফলে জনপ্রশাসন সচিব সব চাপ সামলে দাপ্তরিক কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব এবং উপ-সচিবসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিগত সরকারের পছন্দের ব্যক্তিরা এখনও গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকার বিষয়টি রহস্যজনক হিসাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, সাতটি সচিবের পদ শূন্য রয়েছে। এগুলো আমরা শিগগিরই পূরণ করব। তবে যোগ্য লোকের অভাব রয়েছে। তারপরও সচিব পদ বেশি দিন শূন্য রাখা ঠিক হবে না। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল ও নতুন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে সচিব বলেন, চুক্তিতে নিয়োগ আমি দেই না। বরং উপর থেকে আসে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় শুধু আদেশ জারি করে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, সচিব হিসাবে যোগদান করলাম মাত্র ১৩ দিন। এ সময়ের মধ্যে প্রশাসনে যা হয়েছে তা জাতির কাছে পরিষ্কার। চেষ্টা করছি ভালো কিছু করার। পরিস্থিতি গুছিয়ে উঠতে একটু সময় লাগবে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ জনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে ৩০ জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। টেকনিক্যাল পদ ছাড়া অতীতে যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন, পর্যায়ক্রমে তাদের সবার নিয়োগ বাতিল করা হবে বলে জনপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

টেকনিক্যাল পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বিকল্প লোক না পাওয়া পর্যন্ত বাতিল হচ্ছে না। একটু সময় নিয়ে যোগ্য লোক পাওয়া গেলে তাদের চুক্তিও বাতিল হবে। এছাড়া কিছু পদ সব সরকারের সময় চুক্তিভিত্তিক জনবল দিয়েই পূরণ করতে হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কারণ অনেকে ওই সব পদে কাজ করতে চান না। আবার কারিগরি পদে জেনারেল শিক্ষিত কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হলে যথাযথ হবে না।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, চিকিৎসা, শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সাত মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কোনো সচিব নেই। তাদের কেউ অবসরে গেছেন, কারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে আবার কাউকে ওএসডি করা হয়েছে। নতুন করে ওই সব পদে সচিব নিয়োগ নিয়ে কাজ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব যুগান্তরকে বলেন, অনেকে ইতোমধ্যে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে ৭ দিনের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এটা সরকারের উদারতা। সচিব হিসাবে পদায়নের কিছু শর্ত রয়েছে, যোগ্যতার মাপকাঠিতে অনেকে পিছিয়ে আছেন। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা ভাবছি। আশা করছি শিগাগিরই পদগুলো পূরণ হবে। কারণ সচিব পদ বেশি সময় শূন্য রাখা ঠিক হবে না। সচিব আরও বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পরিবর্তে সার্ভিসে নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে পদগুলো পূরণ করার চিন্তাভাবনা চলছে। সচিব না থাকায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর স্বাভাবিক কাজ মন্থর গতিতে চলছে। আবার সচিব আছেন, এমন মন্ত্রণালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে সচিবালয়ে বিগত সরকারের সময়ে পদোন্নতি ও পোস্টিং বঞ্চিত কর্মকর্তাদের আবেদন জমা দেওয়া শুরু হয়। এ সবের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারসহ (প্রশাসন ছাড়া অন্য ক্যাডার) আদার্স ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন দাবি রয়েছে।

একাধিকবার পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তাও বিভিন্ন দাবি পেশ করেছেন। তাদের এসব দাবি একেবারেই ন্যায্য এবং যৌক্তিক রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কারণ কোনো ধরনের যুক্তিসংগত, দৃশ্যমান এবং আইনানুগ কারণ ছাড়া তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। ৬-৭ বার পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে উপ-সচিব ও যুগ্মসচিব হিসাবে অবসরে যাওয়ার কর্মকর্তার সংখ্যা শতাধিক। তারা হারানো সম্মান ফিরে পেতে চান।

আবার বিগত সরকারের সময় অতিরিক্ত সচিব স্তরে পদোন্নতি পেয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তারা ভূতাপেক্ষভাবে সচিব হিসাবে পদোন্নতির আবেদন করেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিগত সরকারের সময় অতিরিক্ত সচিব হিসাবে অবসরে গেছেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন, সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি ক্রয় করেছেন, গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পোস্টিংয়ে ছিলেন-এমন কর্মকর্তারা বঞ্চিত দাবি করে আবেদন করেছেন।

বিভিন্ন সংস্থা কিংবা অধিদপ্তরে ডিজি ছিলেন-এমন অতিরিক্ত সচিবরাও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি হিসাবে আবেদন করেছেন। ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির যে পরিমাণ আবেদন জমা পড়েছে তা নিষ্পত্তি করতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পোস্টিং বঞ্চিতদের দাবি। পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ বঞ্চিত কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও উদারভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশ কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। পদোন্নতি এখনও অব্যাহত রয়েছে। পদোন্নতি প্রাপ্তদের পর্যায়ক্রমে পোস্টিং দেওয়া হচ্ছে। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পোস্টিং কিংবা পদায়নের ক্ষেত্রে জটিলতা রয়েছে। কারণ তাদের উপ-সচিব, যুগ্মসচিব কিংবা অতিরিক্ত সচিব হিসাবে চাকরির অভিজ্ঞতা নেই। তারপরও তাদের মধ্যে থেকে সচিব পদ পূরণে কাজ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

পদোন্নতি বিধিমালা-২০০২ এর বিধান অনুসারে উপ-সচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পেতে হলে উপ-সচিব হিসাবে ৫ বছর সন্তোষজনকভাবে চাকরি করার শর্ত রয়েছে। যুগ্মসচিব থেকে পদে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৩ বছর সন্তোষজনক চাকরির শর্ত রয়েছে। আবার অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব পদে পদোন্নতির জন্য ২ বছরের সন্তোষজনক চাকরির শর্ত বিদ্যমান। এমন বাস্তবতায় বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দিয়ে সচিব পদ পূরণ জটিল হয়ে পড়েছে।

সেই ক্ষেত্রে সচিব পদে পদোন্নতির জন্য অতিরিক্ত হিসাবে ২ বছরের শর্ত শিথিল করে ১ বছর করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তারপরও পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মকর্তা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পোস্টিংয়ের জন্য দীর্ঘ সময় বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। তারা নিয়মিত ভিড় করছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মাঠপ্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য যোগ্যতার মাপকাঠি অনুসারে জনবল পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের প্রস্তাব করা হলেও তা এখনও অনুমোদন হয়নি। তারা আরও জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক কোনো উপদেষ্টা না থাকায় অনেক সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে।

তাছাড়া প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে সাবেক সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া কিছু কর্মকর্তা এখনও কর্মরত। উপদেষ্টারা তাদের পরামর্শে কাজ করেন। তারা উপদেষ্টাদের কি পরামর্শ দেন বা বলেন, আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বর্তমান চাহিদা কি-সে বিষয়টি বুঝবার কিংবা জানার কোনো সুযোগ অনেক ক্ষেত্রে হয় না। ফলে একটি শূন্যতা থেকে যাচ্ছে এবং সমন্বয়ের সমস্যা হচ্ছে।

কর্মকর্তাদের আবেদন-নিবেদন নিয়ে সার্বক্ষণিক চাপের মধ্যে থেকে কাজ করছেন জনপ্রশাসন সচিব। প্রতিদিন শতাধিক দর্শনার্থী, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারে তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়। তারপও তিনি ক্লান্ত নন বলে জানান জনপ্রশাসন সচিব।

তিনি বুধবার গণমাধ্যমকে বলেন, আল্লাহ আমাকে ১৫ বছর পর দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। দেশ এবং জনগণের জন্য কাজ করে যাব। জনপ্রশাসনে অস্থিরতা প্রসঙ্গে সচিব বলেন, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। একটু সময় লাগবে। সচিব আরও বলেন, যারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের মনে রাখা উচিত-বাচ্চাদের রক্তের বিনিময়ে এ সরকার ক্ষতায় এসেছে। তাদের পরিস্থিতি অনুধাবন করা ও ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দেন তিনি।

অপরদিকে বিগত সরকারে সময় সুবিধাভোগী, দলবাজ এবং অতিউৎসাহী কর্মকর্তারা এখনও স্বপদে বহাল। দলবাজ সচিব থেকে উপ-সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তাদের এখনও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রাখার বিষয়টি অনেকের কাছে রহস্যঘেরা। এ রহস্যের কোনো কূলকিনারা হচ্ছে না। একজন উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের প্রশ্ন। কিন্তু এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম