Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ক্ষমতা অপব্যবহারে রেকর্ড

মাদকের ডিজির ভাই বলে কথা

হাসপাতালে ভাইয়ের দেখভাল করতে পালাক্রমে ডিউটি করছে নারকোটিক্সের ১২ সিপাহি

Icon

তোহুর আহমদ

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাদকের ডিজির ভাই বলে কথা

রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতাল। বিশেষায়িত কার্ডিয়াক আইসিইউতে চিকিৎসাধীন একজন সরকারি কর্মকর্তার আত্মীয়। কিন্তু তাকে ঘিরে সংশ্লিষ্ট অনেকের ঘুম হারাম। ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে দায়িত্বরত ওয়ার্ডবয়-আয়াদের অন্তহীন ছোটাছুটি। হাসপাতালজুড়ে রীতিমতো তটস্থ অবস্থা। এখানেই শেষ নয়, পালাক্রমে রোস্টার অনুযায়ী ডিউটি করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (নারকোটিক্স) ১২ জন সিপাহি।

অতি সৌভাগ্যবান এ রোগীর নাম খোন্দকার আব্দুর রউফ। তিনি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানের বড় ভাই। যিনি ভর্তির পরপরই হাসপাতালে শুরু হয় বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনাগোনা। এমনকি বেশ কজন কর্মচারীকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশও দেওয়া হয়। এমনকি ৯ সেপ্টেম্বর থেকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে সিপাহিদের তালিকাসহ ডিউটি পালনের এক অফিস আদেশ জারি করে নারকোটিক্স।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাপরিচালক এভাবে তার ভাই বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের সেবায় সরকারি জনবল নিযুক্ত করতে পারেন না। এটি চাকরিবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের শামিল।

এদিকে নারকোটিক্সের সাম্প্রতিক এক বদলি আদেশ ঘিরে ডিজির বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে। ওই বদলি আদেশে মাহবুবা জেসমিন রুমাসহ বেশ কয়েকজন বিতর্কিত কর্মচারীকে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কুরবানির পশু কেনা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত নানা কাজে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহারে ডিজির ওপর ক্ষুব্ধ অনেকে।

এসব ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বুধবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তার বড় ভাইয়ের দেখভালের জন্য একজন সিপাহিকে বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে ১২ জনের ডিউটির বিষয়টি আদৌ সত্য নয়। আপনারা খোঁজ নেন, সেখানে ১২ জন আছে না কয়জন আছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাহবুবা জেসিমন রুমা নামের যে কর্মকর্তার পোস্টিং নিয়ে কথা হচ্ছে, ব্যক্তিগতভাবে তাকে তিনি চেনেন না। সরাসরি কখনো তাকে দেখেনওনি। নারকোটিক্সে কর্মচারী দিয়ে নিজের জন্য কুরবানির পশু কেনার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, এজন্য তিনি যথাযথ টাকা দিয়ে দিয়েছেন।

অফিস আদেশ : ডিজির চিকিৎসাধীন ভাইকে দেখভালের জন্য ৯ সেপ্টেম্বর নারকোটিক্সের ঢাকা মেট্রো উত্তর কার্যালয় থেকে এক অভিনব অফিস আদেশ জারি করা হয়। সহকারী পরিচালক রাহুল সেন স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, ‘৯ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর কর্মবণ্টনের তালিকা অনুযায়ী ১২ জন সিপাহি হাসপাতালে ডিউটি করবেন। তারা হলেন তেজগাঁও সার্কেলের সমীর দেবনাথ, রমনা সার্কেলের মো. ইসতিয়াক, মাইন উদ্দিন, গুলশান সার্কেলের মাইদুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, মিরপুর সার্কেলের মমিনুল ইসলাম, ধানমন্ডি সার্কেলের সায়েদুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, মোহাম্মদপুর সার্কেলের সাইফুল ইসলাম সাকিল ও উত্তরা সার্কেলের রুবেল চন্দ্র দাস। এ সংক্রান্ত আদেশে রোস্টারভুক্ত প্রত্যেককে সন্ধ্যা ৭টায় ডিজির বাডিগার্ড হিসাবে নিযুক্ত প্রধান কার্যালয়ের এসআই নাজমুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।

সরেজমিন : বুধবার সকালে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে গেলে জানা যায়, নারকোটিক্স ডিজির ভাই খোন্দকার আব্দুর রউফ ৯ম তলায় কার্ডিয়াক আইসিইউতে ভর্তি আছেন। সম্প্রতি তার বাইপাস সার্জারি করা হয়। তার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। চিকিৎসকের অনুমতি পেলে দু-একদিনের মধ্যে তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হবে।

তখন দুপুর ১২টা। আইসিইউ-এর বাইরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন নারকোটিক্সের এক সিপাহি। নাম মো. ইয়াসিন। তবে তার পরনে সংস্থাটির নির্ধারিত পোশাক (ইউনিফর্ম) নেই। গেঞ্জি ও প্যান্ট পরে (সাদা পোশাকে) ডিউটি করছেন তিনি। হাসপাতালে কী করছেন-এমন প্রশ্নে ইয়াসিন বলেন, ‘এখানে ডিজি স্যারের ভাই ভর্তি আছেন। তাই অফিস থেকে আমাদের ডিউটি দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বড় স্যারদের অনেকেই নিয়মিত আসেন। স্যারের ভাইয়ের খোঁজখবর থেকে শুরু করে দেখভালের সবকিছুই করছেন তারা।

তিনি আরও জানান, সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত এক শিফট এবং ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আরেক শিফটে তাদের ডিউটি চলছে। নির্ধারিত ইউনিফর্ম থাকার পরও এভাবে সাদা পোশাকে ডিউটির কারণ জানতে চাইলে ইয়াসিন বলেন, ‘জানেন তো দেশের পরিস্থিতি ভালো না। তাছাড়া ডিজি স্যারও পোশাক পরে হাসপাতাল ডিউটিতে আসতে বারণ করেছেন।’

বিতর্ক : ৮ সেপ্টেম্বর জারীকৃত এক বদলির আদেশ ঘিরে ডিজির সমালোচনা তুঙ্গে। এ সংক্রান্ত আদেশে মাহবুবা জেসমিন রুমা নামের এক পরিদর্শককে ঘুসের হাট হিসাবে পরিচিত যশোর পণ্যাগারে পোস্টিং দেওয়া হয়। অথচ রুমার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি বদলি আদেশে প্রাইজ পোস্টিং পাওয়া মাহবুবা জেসমিন রুমাসহ বদলিকৃত পরিদর্শকদের বেশিরভাগই ১৩ ব্যাচে নিয়োগপ্রাপ্ত। একই ব্যাচ থেকে একসঙ্গে এতজনকে পদায়ন নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ এমন বদলির পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য খুঁজছেন।

নারকোটিক্সের এক অতিরিক্ত পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, মোস্তাফিজুর রহমান আগে গৃহায়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রাইজ পোস্টিং পাওয়া রুমার স্বামী জাহিদুল ইসলামও গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী। বর্তমানে তিনি যশোর সার্কেলে কর্মরত। ফলে অনেকের ধারণা, ডিজির সঙ্গে স্বামীর পূর্ব যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে যশোরে পোস্টিং নিয়েছেন রুমা। তবে তিনি শুধু একা নন, ব্যাচমেটদেরও অনেককে প্রাইজ পোস্টিং পাইয়ে দেওয়ার পেছনে রুমার হাত রয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম