খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান
শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক মংসুইপ্রু
মুহাম্মদ আবুল কাশেম, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু
এ যেন রূপকথার কল্পকাহিনি। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে শূন্য থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। আছে হাজার বিঘা জমি, অর্ধশতাধিক গাড়ি, বিলাসবহুল বাড়ি ও বিশাল লেক। একসময় যার নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিল, তিনি হয়ে ওঠেন রাজকীয় জীবনের অধিকারী।
‘আলাদিনের চেরাগ পাওয়া’ এই ব্যক্তির নাম মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু। তিনি খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর মংসুইপ্রুও পাহাড়সমান সম্পদ ফেলে আত্মগোপনে রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় সাবেক সংসদ-সদস্য চাচাশ্বশুর কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরার ওপর ভর করেই অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে এসব সম্পদ গড়েছেন মংসুইপ্রু। তার বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ভুয়া প্রকল্পের নামে অর্থ লোপাট, টেন্ডারবাজি, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য, শতাধিক গায়েবি সড়কের টেন্ডার দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দলীয় নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি এবং অর্থের বিনিময়ে বিএনপি-জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যদের দলে অনুপ্রবেশ করানোর অভিযোগও রয়েছে। তার এসব অপকর্মের বৈধতা দিতে উপর মহলকে ম্যানেজ এবং রাজনৈতিকভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা।
জানা যায়, খাগড়াছড়ি পৌরসভার পানখাইয়াপাড়া মারমা গ্রামের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন মংসুইপ্রু। ২০১৫ সালে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরার বড় ভাই লনেন্দ্র লাল ত্রিপুরার মেয়ে স্কুলশিক্ষিকা কুহেলী ত্রিপুরাকে বিয়ে করেন। সেই সুবাদে চাচাশ্বশুরের সুপারিশে জেলা পরিষদ উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পান মংসুইপ্রু। এরপর তার পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ভাগ্য বদলে ফেলেন তিনি। পরে চাচাশ্বশুরের প্রভাবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদটিও পেয়ে যান। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মংসুইপ্রু। তার বিরুদ্ধে জোড়া খুনের মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধের বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।
নিয়োগের নামে ঘুস বাণিজ্য : মংসুইপ্রু পার্বত্য জেলার সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালের ৫ মার্চ জেলা কৃষি অফিসে জনবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম করেন মংসুইপ্র। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মনগড়া রেজাল্ট প্রকাশ করে পছন্দের প্রার্থীকে চাকরি পাইয়ে দেন তিনি। একই বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। ওই সময় প্রায় ২৫০ জন চাকরিপ্রত্যাশীর কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫-২০ লাখ টাকা উৎকোচ নেন।
নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান : মংসুইপ্রুর রয়েছে মেসার্স মং কনস্ট্রাকশন নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুবিধার্থে তিনি মেসার্স রিপ এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা নামে আরও ২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ব্যবহার করতেন। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সব টেন্ডার বাণিজ্য নিজেই সামাল দিতেন চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু ও তার স্বজনরা। এতে নামমাত্র টেন্ডার দেখিয়ে কাজ নিতেন নিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে। আর প্রকল্পের কাজ অর্ধেক সম্পন্ন করে, কখনো কাজ না করে, আবার কখনো বিনা টেন্ডারে কাজ করে টাকা উত্তোলন করতেন। এছাড়া একই কাজের দুটি টেন্ডার দেখিয়েও ভুয়া বিলের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে নিতেন।
টোল ডাকে অনিয়ম-দুর্নীতি : জেলার রামগড় উপজেলার সোনাইপুল ও মানিকছড়ি উপজেলার গাড়ি টানা টোলকেন্দ্রের ডাক প্রকাশ্যে না দিয়ে গোপনে সিন্ডিকেট করে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ডাক নির্ধারণ করেছিলেন মংসুইপ্রু। কিন্তু সরকারি কোষাগারে বা পার্বত্য জেলা পরিষদের ফান্ডে নামমাত্র টাকা জমা দিয়ে বাকি সব টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি।
প্রকল্প কমিটির নামে দুর্নীতি : মংসুইপ্রু জেলা পরিষদের সদস্য থাকাকালে প্রতিবছর পিআইসির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিশেষ করে জামানতের ১০ শতাংশ অর্থ কোনোরকম কাজ না করেই নিজের করে নিয়েছেন। এভাবে গত অর্থবছরেও ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এছাড়া বিগত দিনে পরিষদ চেয়ারম্যানের বাসভবন মেরামতের নামে ২০ লাখ, পরিষদের সার্কিট হাউজ মেরামতের নামে ৪০ লাখ এবং রেস্টহাউজ মেরামতের নামে ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি।
যেভাবে হাজার কোটি টাকার মালিক : খাগড়াছড়ি পানছড়ি কাঁঠালমনিপাড়ায় মংসুইপ্রুর রয়েছে ১২৫০ বিঘা আমবাগান। খাগড়াছড়ি পৌরসভার পানখাইয়াপাড়ায় রয়েছে ৩ তলা বিলাসবহুল বাড়ি। এছাড়া সিন্দুকছড়িতে ১টি, রামগড় পাতাছড়ায় ২টি, মাটিরঙ্গায় ১টি, লক্ষ্মীছড়িতে ২টি ইটভাটা রয়েছে তার। মংসুইপ্রুর ব্যবসায়িক স মিল রয়েছে। ভাইবোনছড়া এলাকায় শত কানি জায়গায় স্থাপন করেন মায়াবিনি লেক। খাগড়াছড়ি সদরের বটতলী এলাকায় রয়েছে ৭ কানি জায়গা। যার বাজারমূল্য ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এছাড়া সিন্দুকছড়িতে ৫০০ বিঘা জমি, গুইমারা উপজেলায় ২০ বিঘা জমি ও ৬০০ বিঘা পাহাড়, দীঘিনালার জামতলী এলাকায় ২০০ বিঘা ও খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার মাইসছড়ি স্কুলের পূর্বপাশে ১০ বিঘা জমি ক্রয় করেন তিনি।
এছাড়া মংসুইপ্রুর অর্ধশতাধিক গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ভাড়ায় চালিত নোয়াহ ও হাইস গাড়ি রয়েছে ৭টি, ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত ট্রাক রয়েছে ৫টি, মংসুইপ্রুর স্ত্রীর রয়েছে একটি প্রাইভেট কার এবং সাজেক ও অন্যান্য জায়গায় ভাড়ায় চালিত পিক-অ্যাপ রয়েছে ৩টি। তার এসব গাড়ির দেখভাল করেন খাগড়াছড়ি সদর গঞ্জপাড়ার কবির ত্রিপুরা। মংসুইপ্রুর এসব সম্পদের মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা হবে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার বর্তমান অবস্থান জানার জন্য প্রতিবেদক তার বাসায় গিয়ে যোগাযোগ করেন। তখন জানা যায়, তিনি সরকার পতনের পর থেকে পলাতক।