
প্রিন্ট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:১৬ পিএম
রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স
সামিট-বেক্সিমকোর নিয়ন্ত্রণে ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ
যে কোনো সময় ইন্টারনেট ক্যু করার ক্ষমতা রাখে আওয়ামীপন্থি গ্রুপ দুটি * নানা অনিয়মের পরও ছাড় পায় মাফিয়া সিন্ডিকেট

আরও পড়ুন
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের অন্যতম খাত টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট। এর নেতৃত্ব দেয় সামিট ও বেক্সিমকো গ্রুপ। ২০০৯ সাল থেকে ডিজিটাল, পরে স্মার্ট, বিভিন্ন সময়ে ইন্টারনেট সঞ্চালন ব্যবস্থার বিভিন্ন ধাপের লাইসেন্স দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। এরই বদৌলতে বর্তমানে দেশের ইন্টারনেট বাজারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণই আওয়ামীপন্থি এসব প্রতিষ্ঠানের হাতে। ইন্টারনেটের মূলত দুটি পর্যায়-ডেটা এবং ভয়েস। আর দুই পর্যায়েরই মাফিয়া সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছে আওয়ামীপন্থি সামিট কমিউনিকেশন্স ও বেক্সিমকো গ্রুপ।
ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) লাইসেন্সপ্রাপ্ত (২৯টি) প্রতিষ্ঠানগুলোকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ‘ভয়েস’ পর্যায় নিয়ন্ত্রণে রাখে বেক্সিমকো তথা সালমান এফ রহমান। প্রতিমাসে প্রায় ১০০ কোটি টাকা আয় হয় এ সিন্ডিকেটের। অপরদিকে ডেটা বা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রিত হয় ইন্টারন্যাশনাল লং ডিসটেন্স কমিউনিকেশন্স (আইএলডিসি) থেকে গ্রাহক পর্যন্ত এবং মোবাইল টাওয়ারসহ প্রয়োজনীয় সব লাইসেন্সধারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান সামিটের। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাবে সঞ্চালনব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন ইন্টারনেটসহ টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের হাতেই থাকে। এমনকি এ মাফিয়া সিন্ডিকেট চাইলে যে কোনো সময় দেশের ইন্টারনেট সংযোগে বিঘ্ন ঘটাতে সক্ষম। যে কারণে নিম্নমানের সেবা ও নানা অনিয়মের পরও অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ছাড় পেত তারা।
বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেক বেশি ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর। অনলাইনে পাঠদান, এমনকি টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণেও অনলাইননির্ভরতা বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ১২ কোটি ৯৪ লাখ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১২ কোটি ৬২ লাখ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ কোটি ৯ লাখ। ক্রমবর্ধমান এ খাত থেকে আধিপত্য বিস্তারে আইএলডিসি থেকে গ্রাহক পর্যায় পর্যন্ত এবং মোবাইল টাওয়ারসহ প্রয়োজনীয় সব লাইসেন্স বাগিয়ে নেয় সামিট।
ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সরবরাহব্যবস্থা ও মালিকানা অনুসন্ধানে দেখা যায়, সামিট কমিউনিকেশন্সের মালিকানা প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ শেখ পরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠ। দেশে বর্তমানে আমদানিকৃত মোট ৬ দশমিক ২ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (২ দশমিক ৫ টেরাবাইট) সরবরাহ করে সামিট। অপরদিকে এনটিটিএন অপারেটর বাহন লিমিটেডে শেয়ার রয়েছে সালমান এফ রহমানের। আইটিসি, আইআইজি ও এনটিটিএন লাইসেন্সধারী আরেক প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোমেরও সখ্য ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে। প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করে ফাইবার অ্যাট হোম। ম্যাঙ্গো টেলিসার্ভিসেস, যারা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর হাত ধরে আইটিসি নবায়ন এবং আইআইজি লাইসেন্স পায়। শেখ ফজলে নূর তাপসের মধুমতি ব্যাংকেও শেয়ার রয়েছে ম্যাঙ্গোর উদ্যোক্তাদের। প্রায় ৩ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথ আমদানি করে ম্যাঙ্গো। আইআইজি অপারেটরদের থেকে এনটিটিএনদের মাধ্যমে সেই ব্যান্ডউইথ যায় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। আইএসপিগুলোই ঝুলন্ত তারের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত বাসাবাড়ি, অফিসে ইন্টারনেট পৌঁছায়।
আইআইজি অপারেটর ‘লেভেল-৩ ক্যারিয়ার লিমিটেডের’ লাইসেন্স পাইয়ে দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ-সদস্য রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক। ভেলোসিটি নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হকের ছেলে নাভিদুল হক। শুধু আইআইজিই নয়, গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সরবরাহকারী আইএসপিগুলোরও নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন আওয়ামীপন্থিরা। গ্রাহকদের জিম্মি করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে ভোক্তা পর্যায়ের ইন্টারনেট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন।
ইন্টারনেট সরবরাহকারী ‘ইউনিফায়েড কোর লিমিটেডের’ চেয়ারম্যান ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসেন। তিনি আবার আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির ভাইস প্রেসিডেন্টও। ‘সান অনলাইন’-এর স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন কদমতলী থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক। নারায়ণগঞ্জে ইন্টারনেট সরবরাহের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেন সাবেক সংসদ-সদস্য শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান। রামপুরায় ছাত্রলীগের নেতা ‘পি নেট পাওয়ার’-এর স্বত্বাধিকারী।
ইন্টারনেট সঞ্চালনের আরেকটি পর্যায় ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জের (নিক্স) লাইসেন্স রয়েছে ১১টি প্রতিষ্ঠানের। এসব ধাপসহ মোবাইল টাওয়ারের লাইসেন্সও আছে সামিটের। টেলিকম খাতে প্রতিমাসে সামিটের আয় কমপক্ষে ১৫০ কোটি টাকা। আবার এ ইন্টারনেটের একটি অংশ মোবাইল টেলিকম অপারেটরগুলোর টাওয়ারের মাধ্যমে যায় মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে। ফলে দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থায় হঠাৎ যে কোনো সময় বিঘ্ন ঘটানোর সক্ষমতা রয়েছে সামিটের।
ইন্টারনেটের আরেকটি পর্যায় ভয়েস। দেশের বাইরের সঙ্গে যোগাযোগে ভয়েস কল সম্পন্ন হয় আইজিডব্লিউ অপারেটরের মাধ্যমে। ২০০৮ সালে বিটিসিএলের সঙ্গে তিনটি প্রতিষ্ঠান-বাংলা ট্রাক ইনফ্রাস্ট্রাকচার, নভোটেল এবং মীর টেলিকমকে প্রথম আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেওয়া হয়। ২০১২ সালে লাইসেন্স পাওয়া ১৯টি প্রতিষ্ঠানসহ ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে ২৪টি অপারেটর সক্রিয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২০টি আইজিডব্লিউকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভয়েস ইন্টারনেট এককভাবে দখলে আছে সালমান এফ রহমানের।
২০১৪ সালে তৎকালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে মিলে সে সময়কার ২৩টি বেসরকারি অপারেটরের মধ্যে ১৮টিকে নিয়ে ‘আইজিডব্লিউ অপারেটর্স ফোরাম (আইওএফ)’ গঠন করেন সালমান। এর মধ্য দিয়ে আইজিডব্লিউ অপারেটরে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত করেন তিনি। এ সিন্ডিকেটে সালমানের সহযোগী ছিল কনফিডেন্স গ্রুপের ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশন্স এবং রুটস কমিউনিকেশন্স। ডিজিকনের লাইসেন্স পেতে সুপারিশ ছিল শেখ ফজলে নূর তাপসের। আর রুটস কমিউনিকেশন্সের ৫০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন সাবেক সংসদ-সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপের স্ত্রী গুলশান আরা।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এ খাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস না করতে পারলে দেশের ইন্টারনেট যে কোনো সময় ক্যু করতে পারে আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনটাই আশঙ্কা করছেন নেটওয়ার্ক বিশেষজ্ঞরা। আর এটা করলে সারা দুনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে।