সীতাকুণ্ডে শিপইয়ার্ডে বিস্ফোরণে দগ্ধ ১২
আটজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক * দগ্ধ স্বামীর মুখ দেখে চিনতে পারেননি স্ত্রী
এমএ কাউসার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রামে একটি জাহাজ ভাঙা কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে ১২ জন শ্রমিক দগ্ধ হয়েছেন। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার শীতলপুর ইউনিয়নের তেঁতুলতলা এলাকায় মেসার্স এসএন করপোরেশন নামে একটি কারখানায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। পুরোনো জাহাজের তেলের ট্যাংক কাটার সময় এ বিস্ফোরণ বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
আহতদের উদ্ধার করে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরে ৮ জনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ভয়াবহ বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধদের শ্বাসনালি পুড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। দগ্ধ অনেককে তাদের স্বজনরাই চিনতে পারছিলেন না। খোদ স্ত্রী তার স্বামীর মুখ দেখে চিনতে পারেননি। পরে পা দেখে শনাক্ত করেছেন।
এদিকে পরিবেশবান্ধব শিপইয়ার্ডে এমন দুর্ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম ও সেফটি কমিটি। তারা শিগগিরই এ ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি ইয়ার্ডের কার্যক্রম বন্ধ রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মেসার্স এসএন করপোরেশনে বিস্ফোরণের ঘটনায় বিকাল ৫টায় গুরুতর দগ্ধ ৮ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন-আহমেদ উল্লাহ (৯০ শতাংশ), আল-আমিন (৮০ শতাংশ), খাইরুল (৮০ শতাংশ), জাহাঙ্গীর (৭০ শতাংশ), বরকত উল্লাহ (৫০ শতাংশ), আনোয়ার হোসেন (৪০ শতাংশ), হাবিব (৪০ শতাংশ) ও কাশেম (৩৫ শতাংশ)। এছাড়া অগ্নিদগ্ধ চারজন চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
তারা হলেন-সাগর, রফিক, সাইফুল ও রফিকুল। তাদের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পুড়েছে। এর মধ্যে সাইফুল ও রফিকুলের কানে সমস্যা হয়েছে।
শিপইয়ার্ডটির মালিক শওকত আলী চৌধুরী। বিস্ফোরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মেসার্স এসএন করপোরেশনের অ্যাডমিন ম্যানেজার ওমর ফারুক বলেন, যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি অনাকাক্সিক্ষত। পুরোনো জাহাজটির পাম্প রুমের একটি পাইপ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেখানে কোনো কাটিং কার্যক্রমও ছিল না। এরপরও এ বিষয়ে তদন্তের পর প্রতিবেদন পাওয়া গেলে প্রকৃত বিষয়টি জানা যাবে। তবে আমাদের কোনো অব্যবস্থাপনার কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশের শিপিং রিসাইক্লিং রুলস, লেবার ল এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিদের্শনা মেনে আমাদের প্রতিষ্ঠানটি জাহাজ ভাঙার কাজ পরিচালনা করে আসছে। তিনি আরও বলেন, বিস্ফোরণের পর শিপইয়ার্ডের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা আমরা পাইনি। এ বিষয়ে রোববার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরু হবে।
দুপুরে চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসায় ব্যস্ত সময় পার করেন চিকিৎসকরা। এ সময় আহতদের স্বজনরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। দগ্ধদের গুরুতর পোড়া চেহারা দেখে অনেকে আঁতকে উঠেন। এ সময় অগ্নিদগ্ধ হাবিবের স্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, আমার স্বামী এসএন করপোরেশনে ফোরম্যান ছিলেন। সকালে ভালোভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে কাজে যান। আমাকে একজন কল দিয়ে জানায় ইয়ার্ডে আগুন লেগেছে। আমার স্বামী অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে মুখ দেখে স্বামীকে চিনতে পারছিলাম না। পরে পা দেখে চিনেছি।
অগ্নিদগ্ধ জাহাঙ্গীরের বরাত দিয়ে তার ভাগিনা মো. আরিফ চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে বলেন, তেলের ট্যাংকের ভেতর অকটেন ছিল। কিন্তু তারা জানতেন না। ট্যাংকটা কাটতে গেলে বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণের সময় এসএন করপোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারও উপস্থিত ছিলেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বলেন, অগ্নিদগ্ধ ১২ জন রোগী আমরা রিসিভ করেছি। এর মধ্যে আটজনের অবস্থা খুবই গুরুতর। তাদের মধ্যে প্রায় সবারই ৫০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে। তাদের ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম ও সেফটি কমিটির নিন্দা : বিস্ফোরণের ঘটনায় সংগঠনের পক্ষ থেকে গভীর ক্ষোভ ও নিন্দা জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে নেতারা বলেন, ৩ জুলাই ফোর স্টার শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় ৪ শ্রমিক মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। তখন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শন রিপোর্টে মালিক পক্ষের সুস্পষ্ট ত্রুটি ও অবহেলার প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে আবারও এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তারা আরও বলেন, গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা প্রমাণ করে শিপ ব্রেকিং সেক্টরে এখনো নিরাপদ কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।