লাশের স্তূপে নাইমুরকে খুঁজে পান মা
লাশ নিয়ে বাসায় ফেরার পথেও হামলার শিকার হন স্বজনরা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মায়ের শত বাধা উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন রাজধানীর গুলশান ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী মো. নাইমুর রহমান। প্রতিদিনই বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বলতেন স্বৈরাচারের পতন হবেই। সেই পতন ঠিকই হলো তবে দেখে যেতে পারলেন না নাইমুর। স্বৈরাচারের দোসরদের বুলেটে প্রাণ দিলেন তিনি। হাসপাতালের মর্গে নাইমুরের মা আট থেকে দশটি লাশ সরিয়ে ছেলের লাশ খুঁজে পান। এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজন ও এলাকাবাসী।
স্বজনরা জানান, ১৯ জুলাই বিকালে নাইমুরের ফোন থেকে কল আসে বাবা মো. খলিলুর রহমানের ফোনে। সেই কলেই জানতে পারেন রাজধানীর উত্তর বাড্ডার এ এম জেড হাসপাতালে পরে আছে নাইমুরের গুলিবিদ্ধ লাশ।
গুলশান ডিগ্রি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন নাইমুর। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় তিনি। পড়ালেখার পাশাপাশি তেজগাঁও এলাকার নর্থ ইন্ড কফি রেস্তোরাঁয় পার্টটাইম কাজ করতেন। পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে সংসারে বাবাকে সহায়তাও করতেন। রাজধানীর গুলশান থানাধীন কালাচাঁদপুর পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা মো. খলিলুর রহমানের বড় ছেলে তিনি। খলিলুর প্রাইভেটকার চালকের কাজ করে সংসার চালান।
মঙ্গলবার দুপুরে কালাচাঁদপুর পশ্চিমপাড়ার পাকা মসজিদ সংলগ্ন ওই বাসায় গিয়ে কথা হয় খলিলুর রহমানের সঙ্গে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় দুই রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকেন খলিলের পরিবার। তিনি জানান, মাত্র ২২ হাজার টাকা বেতনে সংসার চালান। নাইমুর ছিল তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। পড়ালেখা শেষ করে সংসারের হাল ধরবেন এমন আশা ছিল বাবা খলিলের।
তিনি যুগান্তরকে জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন নাইমুর। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর উত্তর বাড্ডা বাজার সংলগ্ন প্রধান সড়কে পুলিশের গুলিতে মারা যান। বুকের মাঝখানে গুলিবিদ্ধ হন নাইমুর। তার মুখ দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। ১৯ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন নাইমুর।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের মোবাইল থেকে একটি ফোন আসে। আমাকে জানতে চাই নাইমুরের কি লাগি। আমি বললাম আমার ছেলে। তখন বলে আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। উত্তর বাড্ডার এ এম জেড হাসপাতালে আসেন। তখন দুই ছেলে, স্ত্রী ও এক ভাগিনাকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলাম। যাওয়ার পথে রাস্তায় প্রচণ্ড গুলির শব্দ আর কাঁদানে গ্যাস দেখতে পাই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয়ে হাসপাতালে গেছি। হাসপাতালের লাশঘরে আট থেকে দশ লাশের মধ্যে থেকে নাইমুরের লাশ শনাক্ত করে তার মা নাসিমা। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। পরিবারের অন্যরাও লাশ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
তিনি বলেন, হাসপাতালের লোক তখন বলে, এখানে পরিস্থিতি খারাপ। লাশ বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। আপনারা লাশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স চাইলে দেয়নি। পরে অটোরিকশায় করে হাতের ওপর লাশ নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওয়ানা হই। বাসায় আসার পথে নতুন বাজার এলাকায় এলে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে পড়ি আমরা। কোকাকোলা ব্রিজের ওখানে এলে আমার ছোট ছেলে মাইবুর রহমান (৮) আর ভাগিনার রিকশাটি আটকে দেয় পুলিশ। রিকশা থেকে নামিয়ে দেয় তাদের। তখন আমার ছোট ছেলে ভয়ে প্রচণ্ড কান্নাকাটি করেছে। পরে বারিধারার ভেতর দিয়ে চলে আসে তারা। তবে আমি ও আমার স্ত্রী ছেলের লাশ নিয়ে কোকাকোলা মোড়ে এলে আন্দোলনকারী ছাত্ররা আমাদের রাস্তা পার করে দেয়। তখন সোয়া ৬টা বাজে। মারামারি চলছিল পুরো এলাকায়। আমার মেজো ছেলের পায়ের ওপর লাশ ছিল। নর্দা এলাকায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আমার মেজো ছেলে সাইমুর রহমানের হাতে প্রচণ্ড জোরে আঘাক করে। অনেক কষ্টে লাশ নিয়ে প্রথমে কালাচাঁদপুরের বাসায় আসি। এরপর সেখানে জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর সদর থানার খোয়াজপুর ইউনিয়নের মঠেরবাজার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি।
খলিলুর রহমান বলেন, আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। মামলার এক নম্বর আসামি করা হবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের সাবেক আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি, ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ পুলিশের বেশ কয়েকজনকে। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যাদের ডাকে আন্দোলনে গিয়ে ছেলে জীবন দিল তারা কেউ খবরও নিল না।