Logo
Logo
×

শেষ পাতা

পুলিশ সদর দপ্তরে আবেদন

পদাবনতির শাস্তি বিলোপের দাবি

রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের অভিযোগ * ঘুস না দেওয়ার অপরাধেও এরকম শাস্তি প্রয়োগ করা হয়েছে

Icon

তোহুর আহমদ

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পদাবনতির শাস্তি বিলোপের দাবি

পুলিশ বাহিনীতে কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসাবে প্রচলিত পদাবনতি বা র‌্যাংক রিভার্সন পদ্ধতির বিলোপ চান ভুক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ, এ ধরনের শাস্তি নিবর্তনমূলক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা হয় রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষ বিবেচনায়। এছাড়া পক্ষপাতমূলক ও স্বেচ্ছাচারী অস্ত্র হিসাবেও ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি একাধিক ভুক্তভোগী পুলিশ সদস্য পদাবনতি শাস্তির বিলোপ চেয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর চিঠি দেন। এছাড়া ভুক্তভোগীদের বেশ কয়েকজন লিখিত অভিযোগ নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করছেন। তাদের একাধিক সদস্য সম্প্রতি যুগান্তরের সঙ্গে তাদের দাবির বিষয়ে কথা বলেন। 
তবে শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসাবে গণমাধ্যমে কথা বলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকায় নাম-পদবিসহ পরিচয় প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা। পুলিশবাহিনীতে পদাবনতি শাস্তির বিতর্কিত প্রয়োগের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, বিভাগীয় শাস্তি হিসাবে পদাবনতির মতো কঠোর দণ্ডের বিধান থাকতে হবে। এটি বিলুপ্ত করা উচিত হবে না। তবে কেউ যদি অহেতুক শাস্তি পান বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার ওপর শাস্তি চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। চাকরিবিধিতেই এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলা আছে। ফলে ঢালাওভাবে শাস্তি তুলে দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিসংগত হবে না। 

বছরখানেক আগে পদাবনতি শাস্তিপ্রাপ্ত সাবেক এক ইনস্পেকটর যুগান্তরকে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করে ১৯৯০ সালে তিনি পুলিশবাহিনীতে যোগ দেন। পুলিশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি রংপুরের তারাগঞ্জ থানার ওসি ছিলেন। কিন্তু তুচ্ছ কারণে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে তাকে পদাবনতি শাস্তি দেওয়া হয়।
 
ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, থানায় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সেসময় তিনি একটি ইন সার্ভিস ট্রেনিং করছিলেন। ট্রেনিং শেষ করে কর্মস্থলে ফিরতে তার কিছুটা দেরি হয়। পরদিন আকস্মিকভাবে তাকে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেকে পাঠান। এ সময় অশ্লীল গালাগালসহ তার সঙ্গে চরম অপেশাদারি আচরণ করা হয়। একপর্যায়ে ইউনিফর্ম না পরে সাদা পোশাকে কেন এসেছেন-এমন প্রশ্ন তুলে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। পরে বিভাগীয় মামলা করে গুরুদণ্ড হিসাবে দেওয়া হয় পদাবনতি। বর্তমানে তিনি ইনস্পেকটর থেকে একধাপ নিচে উপপরিদর্শক (এসআই) হিসাবে রংপুর রেঞ্জে চাকরি করছেন।

তিনি আরও জানান, তার ব্যাচমেটদের অনেকেই এখন পদোন্নতি পেয়ে (সহকারী পুলিশ সুপার) এএসপি হয়ে গেছেন। কিন্তু পদাবনতি শাস্তির কারণে একসময় তার অধীনে যারা শিক্ষানবিশ এসআই (পিএসআই) ছিলেন, তাদের সঙ্গে চাকরি করতে হচ্ছে। এর চেয়ে কষ্টের আর কিছু নেই। 

আরেক ভুক্তভোগী জানান, তিনি রাজধানীর একাধিক থানায় ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ ছিলেন বাড্ডা থানার ওসি। কিন্তু গুলশান বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনৈতিক তদবির না শোনায় তার বিরুদ্ধে ঘুস গ্রহণের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। এমনকি প্রচলিত চাকরিবিধি অনুযায়ী আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যক্তিগত শুনানির সুযোগ না দিয়েই তড়িঘড়ি করে বিভাগীয় মামলা করা হয়। এরপর দ্রুততম সময়ে ইনস্পেকটর থেকে এসআই পদে নামিয়ে দেওয়ার দণ্ড জারি করা হয়। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গের একটি জেলায়। ঘটনার পর অন্যায়ের সুরাহা চেয়ে আমি ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। কিন্তু তিনি আমার কোনো কথাই শোনেননি। বরং উলটো হুমকি দিয়ে বলেন, উত্তরবঙ্গে বাড়ি হয়েও তুই ঢাকায় ওসিগিরি করিস কীভাবে। তুই তো জামায়াত-বিএনপির লোক। বেশি বাড়াবাড়ি করলে চাকরিটাও থাকবে না।’ 

সম্প্রতি পদাবনতি শাস্তিপ্রাপ্ত বাড্ডা থানার এক এএসআই (সহকারী উপপরিদর্শক) যুগান্তরকে বলেন, সরকারি চাকরিতে অপরাধ করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু অভিযোগের ন্যূনতম প্রমাণিত না হলেও কাউকে শাস্তি দেওয়া অন্যায়। অথচ এটা পুলিশবাহিনীতে অহরহ ঘটছে। অথচ শৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরির কারণে প্রকাশ্যে এমন অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় না। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার স্ত্রী-সন্তান আছে। আমি একটা সমাজে বসবাস করি। এভাবে পদাবনতি শাস্তির কারণে অনেকেই আমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করে। আড়ালে কটু কথা বলে। সব মিলিয়ে সরকারি চাকরিতে এসে ব্যক্তিগত জীবনটাই বিষিয়ে উঠেছে। 

পদাবনমন শাস্তিপ্রাপ্ত ইনস্পেকটর পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তা বর্তমানে এসআই পদে ঢাকার মিল ব্যারাকে ট্রাফিক ড্রাইভিং স্কুলে (টিডিএস) চাকরি করছেন। তিনিও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও পরবর্তী শাস্তির প্রক্রিয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলছেন। 

ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জানান, একসময় নওগাঁর আত্রাই থানায় ওসি হিসাবে কর্মরত ছিলেন। থানায় সালিশ-মীমাংসার অভিযোগ তুলে আকস্মিক তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্তকালে তাকে ঢাকায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) সংযুক্ত করা হয়। পরে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির জন্য সিআইডির তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তা তার কাছে মোটা অঙ্কের ঘুস দাবি করেন। এতে রাজি না হওয়ায় তাকে পদাবনতি দেওয়া হয়। 

তিনি বলেন, অন্যায় শাস্তি মওকুফ চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি লিখিতভাবে আবেদন করেন। এ নিয়ে শুনানিতে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেন। কারণ, সরকারি চাকরিতে আমার কর্মকাল রয়েছে ৩ বছর। অথচ আমাকে ৫ বছরের জন্য পদাবনতি শাস্তি দেওয়া হয়। এতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কতটা আক্রোশের বশবর্তী হয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম