মাদক ব্যবসায়ীর থেকে মাসোহারা, অর্থ আত্মসাৎ, নিয়োগ পদবাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতি
টাকার নেশায় বুঁদ ছিলেন সাবেক এমপি ফারুক
তানজিমুল হক, রাজশাহী
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের টানা চারবারের সংসদ-সদস্য (এমপি) ছিলেন ওমর ফারুক চৌধুরী। এ সময় অর্থ ও সম্পদের নেশায় বুঁদ ছিলেন তিনি। টাকাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। কথায় কথায় তিনি নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হতেন। ছিলেন গোদাগাড়ী ও তানোরের অঘোষিত জমিদার। সবার সঙ্গে করতেন অসদাচরণ। এক শিক্ষককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে দেশব্যাপী আলোচনায় আসেন। জোর করে আওয়ামী লীগের এক নেতার বাড়িও নিজের নামে লিখে নিয়েছিলেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফারুক শিক্ষক নিয়োগেই হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত ৪০০ কোটি টাকা। গোদাগাড়ীর শীর্ষ হেরোইন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারার মাধ্যমে আদায় করেছেন অন্তত ৭৫০ কোটি টাকা। তাদের কাছ থেকে নিয়েছেন দামি গাড়িসহ মূল্যবান উপঢৌকনও। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রতিবেদনে সংসদ-সদস্য ফারুককে মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবেও উল্লেখ করেছে।
ফারুক ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে লুট করেছেন কাবিখা ও টিআর প্রকল্পের সরকারি বরাদ্দের অর্থ। একইভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে হাতিয়ে নিয়েছেন টাকা। সরকারি খাদ্যগুদামে ধানচাল সরবরাহ সিন্ডিকেটও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। ফারুক তার মালিকানাধীন থিম ওমর প্লাজায় মাদক ব্যবসায়ীদের দোকান ও ফ্ল্যাট নিতে বাধ্য করেছেন। এর মাধ্যমেও হাতিয়ে নিয়েছেন অর্ধশত কোটি টাকা। দলীয় কর্মসূচি পালনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের করেছেন জিম্মি। নিয়েছেন মোটা অঙ্কের চাঁদা। দলীয় পদবাণিজ্য করেও কামিয়েছেন অঢেল টাকা। দখলে রেখেছিলেন এলাকার হাট ও ঘাট। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ফারুক ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে হাফ ডজন মামলা হয়েছে। এ কারণে অভিযোগ সম্পর্কে ফারুকের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে গোদাগাড়ী ও তানোর থানার ওসি আতাউর রহমান ও আব্দুর রহিম একই রকম তথ্য দিয়ে বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে সাবেক সংসদ-সদস্য ফারুক ও তার রাজনৈতিক সহযোগীরা এলাকায় নেই। তাদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে।
জানা যায়, ফারুক ২০০৮ সালে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গোদাগাড়ী ও তানোরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য শুরু করেন। তাকে টাকা না দিয়ে কেউ নিয়োগ পেতেন না। মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রত্যেক শিক্ষক নিয়োগে তিনি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিতেন। আর প্রধান শিক্ষক নিয়োগে টাকার হার ছিল কমপক্ষে ২০ লাখ। একইভাবে মাদ্রাসা শিক্ষক এবং সুপার নিয়োগেও টাকা নিতেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিক (কলেজ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে নিতেন ১৫ লাখ টাকা আর অধ্যক্ষ নিয়োগে ২০ লাখ।
এসব টাকা আদায়ের জন্য তিনি দলীয় নেতাদের ব্যবহার করতেন। প্রথমদিকে গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি বদিউজ্জামান বদি, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ, তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানী এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন শিক্ষক নিয়োগের টাকা উত্তোলন করতেন। পরে তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১০ বছর এ দায়িত্বে ছিলেন গোদাগাড়ী ও তানোরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম এবং লুৎফর হায়দার রশিদ ময়না ও আবুল বাসার সুজন।
জানা যায়, গোদাগাড়ী উপজেলায় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও মাদ্রাসা মিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০২টি। তানোরে রয়েছে ১০৩টি। গোদাগাড়ীতে মোট শিক্ষক রয়েছেন ২ হাজার ১৬৪ জন। আর তানোরে মোট শিক্ষকের সংখ্যা দুই হাজার ২০৭ জন। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষক সংসদ-সদস্য ফারুক নিয়োগ দিয়েছেন। সব পর্যায়ের শিক্ষকপ্রতি ১৪ লাখ টাকা করে নিলেও এ খাত থেকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ফারুক।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী হেরোইনের আন্তর্জাতিক রুট। এ এলাকায় রয়েছে শতাধিক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে অর্ধশতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রতিমাসে ফারুক ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা মাসোহারা নিতেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থিম ওমর প্লাজার একজন কর্মচারী জানান, থিম ওমর প্লাজায় সংসদ-সদস্য ফারুকের রাজনৈতিক কার্যালয় ছিল। রাত ১১টার পর তিনি সেখান থেকে নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিতেন। এরপর শুরু হতো মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিল গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম টিপু, তার বড় ভাই গোদাগাড়ী পৌরসভার কাউন্সিলর মনিরুল ইসলাম মনি, মাদক ও হুন্ডি ব্যবসায়ী আসাদুল, জসিম, বাবু, দারোগা ও পোয়া বাবুর।
বছরে তিনি প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা শুধু মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মাসোহারা নিতেন। এভাবে ১৬ বছরে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৭৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়ে মধ্যস্থতা করতেন গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস, গোদাগাড়ী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম ও গোদাগাড়ী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম। এছাড়া তিনি মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিতেন দামি উপঢৌকন। মাদক ব্যবসায়ী টিপুর কাছ থেকে নিয়েছেন ৩২ লাখ টাকা দামের একটি কালো রঙের হাইস মাইক্রোবাস। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ ২০২২ সালের ২৭ জুলাই যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছিল।
ফারুক তার মালিকনাধীন থিম ওমর প্লাজায় গোদাগাড়ী ও তানোরের অর্ধশতাধিক মাদক ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকে দোকান ও ফ্ল্যাট নিতে বাধ্য করেন। এর মধ্যে অনেকে নিয়েছেন একাধিক দোকান ও ফ্ল্যাট। এক্ষেত্রে প্রতিটি দোকানের জন্য আদায় করা হয়েছিল ৪০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা। আর ফ্ল্যাটের জন্য কোটি টাকা। এভাবে তিনি ৮০টি দোকান ও ফ্ল্যাট উচ্চদামে বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন অর্ধশত কোটি টাকা।
সাবেক সংসদ-সদস্য ফারুকের নির্বাচনি এলাকায় বছরে টিআর ও কাবিখা প্রকল্প আসত তিনবার। এ বাবদ বরাদ্দ ছিল ছয় কোটি টাকা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ-মাদ্রাসাসহ সামাজিক সংগঠনকে এ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি দেওয়া হয়নি। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে এ বরাদ্দের শতকরা ৮০ ভাগই নিয়েছেন সংসদ-সদস্য ফারুক।
এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) দুই উপজেলায় আসত প্রতিবছর চার কোটি টাকা। এ বরাদ্দও ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে ৮০ ভাগ টাকা হাতিয়ে নিতেন ফারুক। চর আষাড়িয়াদহের সড়ক সংস্কারের ৫টি প্রকল্পের পুরো ২২ লাখ টাকা কাজ না করে আত্মসাৎ করেন। এভাবে ১৬ বছরে এ তিন খাত থেকে প্রায় ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি।
গোদাগাড়ী এবং তানোরে সরকারি গুদামে ধান ও চাল প্রকৃত কৃষকরা দিতে পারতেন না। গুদামে ধান ও চাল সরবরাহ করতেন ফারুকের সহযোগীরা। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন গোদাগাড়ী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম। এছাড়া দলীয় পদবাণিজ্য করেও ফারুক টাকার পাহাড় গড়েছেন। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা লঙ্ঘন করে তিনি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে তিনটি করে কমিটি দিয়েছেন।